রাজ্যে প্রথম একক ভাবে পদ্ম-ফোটা আসানসোল জয় খুব ‘আসান’ নয় বিজেপির, তৃণমূল কি শত্রুঘ্নে স্বস্তিতে?
আনন্দবাজার | ৩১ মে ২০২৪
বাবুল সুপ্রিয় এখন তৃণমূলের। বালিগঞ্জের বিধায়ক। রাজ্যের মন্ত্রীও। তবে বিজেপির ইতিহাসে তাঁর নাম কখনও মোছা যাবে না। কারণ, তিনিই এই রাজ্যের কোনও আসনে একক ভাবে পদ্মের টিকিটে জয়ী সাংসদ। সেই হিসাবে আসানসোল লোকসভাতেই প্রথম বার পদ্ম ফোটে। দমদমে তপন সিকদার, কৃষ্ণনগরে সত্যব্রত মুখোপাধ্যায়, দার্জিলিঙে যশবন্ত সিংহ জিতেছেন। কিন্তু কোনও না কোনও দলের সঙ্গে বিজেপির জোট ছিল। ২০১৪ সালে বাবুলের সঙ্গে সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়াও জিএনএলএফের সঙ্গে জোট বেঁধে জিতেছিলেন পাহাড়ে। এ বার সেই বাবুল নেই। বদলে এসেছেন অহলুওয়ালিয়া। পক্ষান্তরে, দোলা সেন, মুনমুন সেন পর্ব টপকে তৃণমূলের প্রার্থী বিদায়ী সাংসদ শত্রুঘ্ন সিন্হা।
২০১৪ এবং ২০১৯— পর পর দু’বার আসানসোলে বিজেপির টিকিটে জয় পান বাবুল। প্রথম বার আসানসোল জিততে এবং বাবুলকে জেতাতে স্বয়ং নরেন্দ্র মোদী এসেছিলেন আসানসোলে। বলেছিলেন, ‘‘মুঝে পার্লামেন্ট মে বাবুল চাহিয়ে।’’ মোদীর আশাপূরণ করেছিলেন আসানসোলের ভোটাররা। ২০১৪ সালে এই রাজ্যে সে ভাবে ‘মোদী হাওয়া’ কাজ না করলেও বড় ব্যবধানে আসানসোল জিতেছিল বিজেপি।
২০১৯ সালে রাজ্যে ১৮ আসনে জয়-পাওয়া বিজেপি আসানসোলে দলের জমি আরও শক্ত করে নেয়। ব্যবধান বাড়িয়ে দ্বিতীয় বার জয় পান বাবুল। ২০০৯ সালে ওই আসনে তৃতীয়-হওয়া বিজেপি পেয়েছিল মাত্র ৫.৫৬ শতাংশ ভোট। আর ২০১৪ সালে প্রথম জয়ে বিজেপির ভোট ৩১ শতাংশ থেকে বেশি বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৩৬.৭৫ শতাংশ। ২০১৯ সালে আরও ১৪.৪১ শতাংশ ভোট বাড়িয়ে বিজেপির দখলে আসে ৫১.১৬ শতাংশ ভোট। জয়ের ব্যবধান হয়ে যায় প্রায় দু’লক্ষ।
পর পর দু’বারই মোদীর মন্ত্রিসভায় জায়গা পান বাবুল। কিন্তু ২০২১ সালের পরে পরিস্থিতি বদলে যায়। বাবুল নীলবাড়ির লড়াইয়ে টালিগঞ্জ বিধানসভা আসনে তৃণমূলের অরূপ বিশ্বাসের কাছে ৫০ হাজার ভোটে পরাজিত হওয়ার পরে কেন্দ্রের মন্ত্রিত্বও খোয়ান। ক্ষোভে সাংসদ পদ ছেড়ে তৃণমূলে যোগদান করেন বাবুল। ফলস্বরূপ আসানসোলে উপনির্বাচন এবং তৃণমূলের জয়। বলিউড তারকা শত্রুঘ্ন বিজেপিকে ‘খামোশ’ করে তিন লাখের বেশি ভোটে জিতে যান ২০২২ সালে। হারিয়েছিলেন আসানসোল দক্ষিণের বিজেপি বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পালকে। এ বার অগ্নিমিত্রা মেদিনীপুর আসনে আর প্রথমে দার্জিলিং এবং পরে বর্ধমান-দুর্গাপুরের সাংসদ অহলুওয়ালিয়া প্রার্থী শত্রুঘ্নের বিরুদ্ধে।
উপনির্বাচনে ৫৬.৬২ শতাংশ ভোট পাওয়া এবং তার আগে আগে ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের নিরিখে এগিয়েই তৃণমূল। গত লোকসভা ভোটের ফলাফলের নিরিখে সাতটি বিধানসভাতেই এগিয়ে ছিল বিজেপি। কিন্তু নীলবাড়ির লড়াইয়ে বিজেপি জয় পায় মাত্র দু’টি আসনে। বাকি পাঁচটিতেই তৃণমূল। তবে উপনির্বাচনের ফলাফলের সঙ্গে যেমন সাধারণ নির্বাচনের তুলনা চলে না, তেমনই এই রাজ্যে বিধানসভা এবং লোকসভা ভোটও আলাদা। সেই হিসাবে অঙ্কে এগিয়ে বিজেপি। কিন্তু মনোবলে তৃণমূল।
একটা সময় আসানসোল দীর্ঘ সময় সিপিএমকে সমর্থন দিয়ে এসেছে। যদিও স্বাধীনতার পরে কংগ্রেসের ছিল আসনটি। কংগ্রেস নেতা অতুল্য ঘোষও ওই আসনে জিতেছিলেন দু’বার। তবে ১৯৭১ থেকেই সিপিএমের দখলে চলে গিয়েছিল ওই আসন। মাঝে দু’বার ১৯৮০ এবং ১৯৮৪ সালে ফের কংগ্রেসের দখলে যায় আসানসোল। দু’বারই জেতেন কংগ্রেসের আনন্দগোপাল মুখোপাধ্যায়। কিন্তু ১৯৮৯ থেকে ২০১৪— টানা ২৫ বছর বামেদের দখলে ছিল আসানসোল। তিন বার হারাধন রায়, তিন বার বিকাশ চৌধুরী এবং দু’বার বংশগোপাল চৌধুরী আসানসোলের সাংসদ হয়েছেন সিপিএমের টিকিটে।
লক্ষ্য করে দেখার মতো যে, বামের ভোট রামে গিয়েই বিজেপির উত্থান। অন্য দিকে, বামেদের পতন। তৃণমূলের ভোটও ২০১৪ সালে বিজেপিতে গিয়েছিল। বিজেপি ৩১.১৯ শতাংশ ভোট বাড়ালে সিপিএম এবং তৃণমূলের কমে যথাক্রমে ২৬.৩০ এবং ৯.৯৫ শতাংশ। ২০১৯ সালে সিপিএমের কমে আরও ১৫.৩১ শতাংশ ভোট। বিজেপির বেড়েছিল ১৪.৪১ শতাংশ। সে বার তৃণমূলের ভোটও ৪.৬১ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। গত লোকসভা নির্বাচনে এই আসনে কংগ্রেস ভোট পেয়েছিল মাত্র ১.৭২ শতাংশ। এ বার জোটের তরফে সিপিএম প্রার্থী করেছে জামুড়িয়ার প্রাক্তন বিধায়ক জাহানারা খানকে। ২০১১ এবং ২০১৬ সালে প্রবল তৃণমূল হাওয়ার মধ্যেও জিতেছিলেন জাহানারা। অথচ ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে দু’বারের বিধায়ককে সরিয়ে দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উঠে আসা ঐশী ঘোষকে প্রার্থী করেছিল সিপিএম। তবে আসানসোল ফিরে পেতে সাদামাঠা জীবনে অভ্যস্ত জাহানারাকেই এগিয়ে দিয়েছে সিপিএম। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ বার তাঁর লড়াই শুরু খুবই অল্প পুঁজি নিয়েই।
তবে এ বার বলিউডের ‘বিহারিবাবু’-কে নিয়ে খানিক চিন্তায় আছে তৃণমূলও। দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সবচেয়ে আগে আসানসোলের প্রার্থী হিসাবে শত্রুঘ্নের নাম জানিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রচারে সবচেয়ে কম পাওয়া গিয়েছে তাঁকে। উপনির্বাচনে জেতার পরে আসানসোলের চেয়ে মুম্বইয়েই বেশি সময় কেটেছে তাঁর। ফলে তাঁকে ‘বহিরাগত’ বলে প্রচার করছে বিজেপি। মনেও। অন্য দিকে, অতীতে দুই আসনে জেতা অহলুওয়ালিয়া এ বার ‘ভূমিপুত্র’ হিসাবে লড়ছেন। এই লোকসভা এলাকাতেই তাঁর বাড়ি। তবে শত্রুঘ্ন এবং অহলুওয়ালিয়ার মধ্যে একটা ‘বড়’ মিল রয়েছে। দু’জনেই বিজেপি সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রী। অহলুওয়ালিয়া নরেন্দ্র মোদী মন্ত্রিসভায়। শত্রুঘ্ন অটলবিহারী বাজপেয়ী মন্ত্রিসভায়।
চলচ্চিত্রের মতো রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও শত্রুঘ্নের ইতিহাস রঙিন। ১৯৯১ সালে অভিনেতা রাজেশ খন্না কংগ্রেসের টিকিটে নতুন দিল্লি আসন থেকে ভোট লড়েছিলেন। হেরে যান বিজেপির লালকৃষ্ণ আডবাণীর কাছে। সে বার গান্ধীনগর থেকেও সাংসদ হয়েছিলেন আডবাণী। নতুন দিল্লি আসন তিনি ছেড়ে দেওয়ায় উপনির্বাচন হয়। সেখানে বিজেপির শত্রুঘ্নকে হারিয়ে সাংসদ হন কংগ্রেসের রাজেশ। ১৯৯৬ সালে রাজেশ ওই আসনে বিজেপির কাছে হেরে যান। তবে শত্রুঘ্ন আর প্রার্থী হননি। পরে বিজেপি তাঁকে রাজ্যসভার সাংসদ করে। বাজপেয়ী মন্ত্রিসভায় জায়গা পান শত্রুঘ্ন। ২০০৯ সালে পটনা সাহিব আসন থেকে আর এক অভিনেতা শেখর সুমনকে হারিয়ে বিজেপি সাংসদ হন শত্রুঘ্ন। এখন অবশ্য শেখর আবার বিজেপিতে। ১৯৯৯ সালে শত্রুঘ্নকে পূর্ণমন্ত্রী করেন বাজপেয়ী। তবে ২০১৪ সালে ওই আসন থেকে আবার জিতলেও মোদীর মন্ত্রিসভায় জায়গা হয়নি তাঁর। ২০১৯ সালে তাঁকে টিকিটও দেয়নি বিজেপি। শত্রুঘ্ন কংগ্রেসে যোগ দেন। ‘হাত’ প্রতীকে পটনা সাহিব আসন থেকে লড়াই করে বিজেপির রবিশঙ্কর প্রসাদের কাছে বিরাট ব্যবধানে হারেন।
তার পরেই ২০২২ সালে আসানসোল উপনির্বাচনে তৃণমূলের প্রার্থী হওয়ার প্রস্তাব পেয়ে কংগ্রেস ছাড়েন ‘বিহারিবাবু’। জিতে যান আসানসোলে।
দলবদলের ইতিহাস রয়েছে অহলুওয়ালিয়ারও। প্রথমে রাজ্যসভা সাংসদ হন কংগ্রেসের টিকিটে বিহার থেকে। ১৯৮৬ এবং ১৯৯২ সালে। নরসিংহ রাও সরকারে মন্ত্রীও হন। তার পরে যান বিজেপিতে। আবার ২০০০ এবং ২০০৬ সালে রাজ্যসভায় যান। এর পরে আরও দু’বার লোকসভায়। এ বার তাঁর সংসদে সপ্তম বার এবং লোকসভায় তৃতীয় বার যাওয়ার লড়াই।
বলা হয়, রাজনীতির ক্ষেত্রে অহলুওয়ালিয়ার ভাগ্যও তাঁর সহায়। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে দার্জিলিংয়ের সাংসদ যশোবন্ত সিংহ আর পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রার্থী হতে না চাওয়ায় বিকল্প প্রার্থীর সন্ধান শুরু করে বিজেপি। প্রথমে সত্যপাল মহারাজ ও পরে রাজীব প্রতাপ রুডির নাম বিবেচনায় উঠে আসে। কিন্তু শিকে ছেঁড়ে অহলুওয়ালিয়ার ভাগ্যে। দু’লাখের বেশি ভোটে জেতেন তিনি। ২০১৯ সালে দার্জিলিং আসনে বিজেপি টিকিট দেয় রাজু বিস্তাকে। তখন মনে হয়েছিল, আর টিকিট পাবেন না অহলুওয়ালিয়া। কিন্তু ভোটের দিন পনেরো আগে বর্ধমান-দুর্গাপুর লোকসভা কেন্দ্রে প্রার্থী হিসাবে তাঁরই নাম ঘোষণা করে বিজেপি। মাত্র দু’সপ্তাহের প্রচারে বাজিমাত করেন সুরেন্দ্র। তবে ব্যবধান ছিল মাত্র ২৪৩৯ ভোট।
এ বার আসানসোলে তাঁর প্রার্থী হওয়ার পিছনেও ঘটনার ঘনঘটা। প্রথমে ভোজপুরি সিনেমার ‘পাওয়ার স্টার’ পবন সিংহকে প্রার্থী হিসাবে ঘোষণা করে বিজেপি। কিন্তু তৃণমূলের আক্রমণের মুখে সরে দাঁড়ান পবন। ২০২১ সালে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগদান করা আসানসোলের প্রাক্তন মেয়র জিতেন্দ্র তিওয়ারিকে প্রার্থী করার বিষয়েও অনেক দূর কথা এগোয়। শেষ মুহূর্তে তাঁর সঙ্গে এনআইএ আধিকারিকের বৈঠকের খবর তৃণমূল প্রকাশ্যে আনতেই জিতেনকে প্রার্থী করার বিষয়টি আটকে যায়। ফের ‘ভাগ্যের খেল’ দেখান অহলুওয়ালিয়া।
তাঁর প্রতি ভাগ্য সদাপ্রসন্ন থাকলেও অহলুওয়ালিয়া এক বার হেরেছেন। সে-ও আসানসোলেই। ১৯৯৮ সালে কংগ্রেসের টিকিটে আসানসোল থেকে প্রার্থী হয়েছিলেন। ‘হাত’ প্রতীকে লড়ে শোচনীয় পরাজয় হয়েছিল তাঁর। এ বার কী হবে? বাবুল-কালের ভোট অক্ষত থাকবে বিজেপির? না কি উপনির্বাচনের ছায়া পড়বে আসানসোলে?