ভাবনা ছিল ৮৮,৯৫২ ভোটের পুঁজি নিয়ে লড়াই করবেন দিলীপ ঘোষ। এই ব্যবধানেই গত লোকসভা নির্বাচনে তিনি জিতেছিলেন মেদিনীপুরে। কিন্তু তাঁকে লড়তে হচ্ছে মাত্র ২,৪৩৯ ভোটের পুঁজি নিয়ে। পাঁচ বছর আগে এমন কম ব্যবধানে জয়ী সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়া যদি কয়েক লক্ষ ভোটের ব্যবধানে জেতা আসানসোল ‘পুরস্কার’ পেয়ে থাকেন, তবে বর্ধমান-দুর্গাপুরে দিলীপকে অথৈ জলে ফেলে দেওয়া হয়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না। বিজেপির জেতা আসন হলেও শস্যগোলা বর্ধমান এবং শিল্পাঞ্চল দুর্গাপুরকে নিয়ে তৈরি লোকসভা আসনে তৃণমূলের সঙ্গে টক্কর সমানে সমানে। দিলীপের উল্টো দিকে এককালের কীর্তিমান ক্রিকেটার কীর্তি আজাদ। যিনি আবার অতীতে বিজেপির হয়েও ভোট জিতেছেন। পাশাপাশি সিপিএম প্রার্থী বর্ধমানের প্রাক্তন কলেজ অধ্যক্ষ সুকৃতি ঘোষালেরও আশা রামে যাওয়া ভোট ফিরবে বামে।
বর্ধমান-দুর্গাপুর লোকসভা দু’টি জেলা মিলিয়ে। পূর্ব এবং পশ্চিম বর্ধমান। ২০০৯ সালে আসন পুনর্বিন্যাসের জেরে এই কেন্দ্রটি গঠিত হয়। বর্ধমান, কাটোয়া এবং দুর্গাপুর— তিনটি লোকসভা কেন্দ্রের জায়গায় রাজনৈতিক মানচিত্রে আসে বর্ধমান পূর্ব এবং বর্ধমান-দুর্গাপুর লোকসভা কেন্দ্র। ২০০৯ সালে এই আসনে প্রথম জিতেছিল সিপিএম। ২০১৪ সালে আসনটি দখল করে তৃণমূল। এখন সেটি বিজেপির দখলে। ফলে কারও ‘গড়’ বলা যাবে না। কারণ, জয় সকলেই পেয়েছে এক বার করে। প্রথম বার সিপিএমের সাইদুল হক জিতেছিলেন ১,০৮,২৩৭ ভোটে। ঠিক পরের বার তৃণমূলের সঙ্ঘমিত্রা মমতাজ জয় পান ১,০৭,৩৩১ ভোটে। সাইদুল দ্বিতীয় হন। তৃতীয় স্থানে বিজেপির দেবশ্রী চৌধুরী। ২০০৯ এবং ২০১৪ সালে তৃণমূলের ভোট খুব একটা কমেনি বা বাড়েনি। আসলে বিজেপির ভোট ৪.৪১ থেকে বেড়ে ১৭.১৮ শতাংশ হয়ে যায়। বিজেপির ভোট বেড়েছিল ১৩ শতাংশের মতো। সিপিএমের ভোট কমেছিল ১৭ শতাংশের কাছাকাছি।
২০১৯ সালের ভোটে প্রার্থিতালিকা থেকে ভোটের ফল— অনেক কিছুই বদলে যায়। তৃণমূল সাংসদ মুমতাজকে টিকিট দিলেও দেবশ্রীকে বিজেপি নিয়ে যায় রায়গঞ্জে। সেখানে জিতে কেন্দ্রে মন্ত্রীও হন দেবশ্রী। আর প্রাক্তন মন্ত্রী অহলুওয়ালিয়াকে দার্জিলিং থেকে এই আসনে নিয়ে আসে বিজেপি। সিপিএম প্রার্থী বদলে টিকিট দেয় আভাস রায়চৌধুরীকে। বামেদের ভোট কমে যায় আরও ২২.৩৩ শতাংশ। বিজেপির ভোট বৃদ্ধি পায় প্রায় ২৪ শতাংশ। ভোট কমে তৃণমূলেরও। বিজেপি জিতলেও তারা এগিয়ে ছিল মাত্র তিনটি বিধানসভা আসনে। দুই দুর্গাপুর এবং গলসি। সর্বত্র ব্যবধান কম হলেও দুর্গাপুর পশ্চিম বিজেপিকে অনেকটা এগিয়ে দেয়। অল্প ভোটে জয় পান অহলুওয়ালিয়া। তবে গত বিধানসভা নির্বাচনে দুর্গাপুর পশ্চিমে প্রত্যাশিত জয় ছাড়া কোনও আসনেই সুবিধা করতে পারেনি বিজেপি।
এমনই এক হিসাব নিয়ে লড়াই দিলীপ-কীর্তি-সুকৃতীর। তিন জনের মধ্যে বাংলার রাজনীতিতে সবচেয়ে পরিচিত নাম অবশ্যই দিলীপ। আরএসএস প্রচারক দিলীপ বিজেপিতে যোগ দেওয়ার ছ’মাসের মধ্যে রাজ্য সভাপতি হয়েছিলেন। দু’দফায় সভাপতি থাকার মধ্যেই প্রথমে খড়্গপুর সদর বিধানসভা থেকে বিধায়ক ও পরে মেদিনীপুর থেকে সাংসদ হন। নিজে জেতার সঙ্গে দলের সাংসদ সংখ্যা তাঁর আমলে ২ থেকে ১৮ হয়ে যায়। বিধায়ক সংখ্যা বেড়ে ৩ থেকে হয় ৭৭। এ হেন দিলীপের আসনই এ বার বদলে দেন নেতৃত্ব।
মেদিনীপুরে তৃণমূল প্রার্থী মানস ভুঁইয়াকে বড় ব্যবধানে হারানো দিলীপের আসন বদলের পিছনে অনেক নাটক। সে নাটকের অন্যতম চরিত্র দিলীপ নিজেই। বারংবার দলকে অস্বস্তিতে ফেলে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের রোষের মুখে পড়তে হয় দিলীপকে। আসন বদলের পরেও সে পর্ব চলেছে। তবে দলের পক্ষে আসন বদলের কারণ হিসাবে বলা হয়, কীর্তির মতো প্রার্থীর বিরুদ্ধে লড়াই করতেই দিলীপকে এই আসনে প্রয়োজন ছিল।
কীর্তির রাজনৈতিক কীর্তিও কম নয়। তাঁর ক্রিকেট জীবনে আইপিএল ছিল না। নতুন দিনের এই ক্রিকেট সম্পর্কে ভুরু কোঁচকানো কীর্তি ২০ ওভারের খেলাকে ক্রিকেটই মনে করেন না। তবে রাজনীতিতে তিনি আইপিএলের মতোই দলবদল করেছেন। ভারতীয় ক্রিকেট দলের প্রাক্তন অলরাউন্ডার তথা ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য কীর্তি ১৯৯৯, ২০০৯ এবং ২০১৪ সালে বিজেপির টিকিটে বিহারের দ্বারভাঙ্গা আসন থেকে জয়ী হন। বাবা ভগবত ঝা আজাদ ছিলেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী। ২০১৫ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী প্রয়াত অরুণ জেটলি সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্যের জন্য বিজেপি বহিষ্কার করে কীর্তিকে। ২০১৯ সালে দল বদলে কীর্তি কংগ্রেসের টিকিটে ধানবাদ আসন থেকে লড়েন। বিজেপি প্রার্থী পশুপতিনাথ সিংহের কাছে হেরেছিলেন লাখ পাঁচেক ভোটে। এর পরে তৃণমূলে যোগদান, গোয়ার দায়িত্ব এবং বর্ধমান-দুর্গাপুর আসনে ঘাসফুলের প্রার্থী।
সিপিএম প্রার্থী সুকৃতীর পরিচয় মূলত শিক্ষাক্ষেত্রে। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর এবং পিএইচডি করার পরে হুগলির রবীন্দ্র মহাবিদ্যালয় ও হাওড়ার বিজয়কৃষ্ণ গার্লস কলেজে শিক্ষকতা করেন। পরে বর্ধমানের মহারাজাধিরাজ উদয়চাঁদ মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ হিসাবে যোগ দেন। ২০২০ সালে স্বেচ্ছা অবসর নেন। এর পরে কিছু দিন হাওড়ায় হিন্দি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার হিসাবেও কাজ করেন। ছাত্রাবস্থায় এসএফআই করতেন। কর্মজীবনে কলেজ শিক্ষকদের বাম সংগঠনে যুক্ত ছিলেন। এ বার প্রথম বার লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী। ‘পুঁজি’ বলতে গত লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে মিলিয়ে ১৪ শতাংশের মতো ভোট। তবে তাঁর দিকে তাকিয়ে রয়েছে দুই ফুলই।
গত বার দুই দুর্গাপুরের উপরে ভর করেই বিজেপি শেষ ধাপে হারিয়ে দিয়েছিল প্রতিপক্ষকে। কিন্তু তৃণমূলকে এ বার চিন্তায় রেখেছে গলসি এবং বর্ধমান দক্ষিণ আসনও। মাথা ঘামাতে হচ্ছে মন্তেশ্বর নিয়েও। কারণ, এই সব জায়গায় রামমন্দির হাওয়া জোরালো ছিল। বাকি সব জায়গাই এখনও তৃণমূলের ‘গড়’। ফলে আশা-আশঙ্কার মাঝে পদ্মের মতো ঘাসফুলও তাকিয়ে তৃতীয় পক্ষের দিকে। কারণ, বামেরা যদি এ বার নিজেদের ভোট বাড়াতে পারে, তা হলেই পদ্ম সরিয়ে ফের ফুটতে পারে ঘাসফুল। অন্তত অঙ্ক তো সেটাই বলছে।
তবে অঙ্ক নয়, বর্ধমান-দুর্গাপুর এ বারের নির্বাচনে খ্যাত বাণী-যুদ্ধের জন্য। কীর্তি-দিলীপ টক্কর চলছে প্রথম দিন থেকেই। তবে এগিয়ে দিলীপ। সকলে ঘুম থেকে ওঠার আগেই দিলীপের বাণী উত্তেজনা ছড়িয়ে দিচ্ছে। প্রার্থী হয়ে এলাকায় গিয়েই তিনি কীর্তির উদ্দেশে বলেন, “আমি বোলার দেখি না, বল দেখি। এখানে পিচ যেমনই হোক, ব্যাটসম্যান কিন্তু আমি।” প্রতিপক্ষকে খোঁচা দিয়ে বলেন, “কীর্তি আজাদ অবসরপ্রাপ্ত ক্রিকেটার। তাঁকে আমি সম্মান করি। তবে ফর্মে নেই। গত বার কংগ্রেসের হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। কত ভোট পেয়েছিলেন?’’ কীর্তির গায়ে ‘বহিরাগত’ তকমা লাগাতেও মরিয়া থেকেছেন তিনি। পাল্টা তৃণমূলও মেদিনীপুর থেকে আসা দিলীপকে একই তকমা দেয়। কীর্তি বলেন, “আমি দেশের হয়ে বিশ্বকাপ জিতেছি। বিশ্বকাপ কি কোনও প্রদেশের হয়? উনি তো মেদিনীপুর থেকে এখানে এসেছেন।”
প্রচারে শক্তিগড়ে গিয়ে ল্যাংচার দোকানে কীর্তি বড় কড়াইয়ে ল্যাংচা ভাজেন। শুনে দিলীপ বলেন, ‘‘আমি তো ভাজাভাজি করি না। তবে উনি এ বার ভেরেন্ডা ভাজবেন।’’ কীর্তি তাঁকে উদ্দেশ্য করে ‘পাগল’ বলে কটাক্ষ করেন। বলেন, ‘‘পাগলে কী না বলে, ছাগলে কী না খায়!’’ তা নিয়ে দিলীপের জবাব, ‘‘কে পাগল, সেটা ভোটের ফলাফলের দিন দেখা যাবে। এমন হারাব যে, জীবনে ভোটে দাঁড়াবেন না।’’ বলেন, ‘‘সবে অ্যাসিড ঢালা হয়েছে। ইঁদুর, পোকামাকড় সব বেরোচ্ছে। ভোটের পর সব বেরিয়ে আসবে।’’ কীর্তিও কম যান না। দিলীপ সম্পর্কে তিনি পাল্টা বলেন, ‘‘একটা গরম কড়াইতে যখন ভুট্টার দানা ছাড়া হয়, তখন ফটফট করে আওয়াজ হয়। উনিও সে ভাবে ফুটছেন।’’
এ সবের মধ্যেই দিলীপ একটা অন্য রাজনীতিও করছেন। কখনও তৃণমূলের জলসত্রে ইদের দিনে গিয়ে শরবত খেয়েছেন, তো কখনও বিরোধী পক্ষের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জখম কর্মীকে দেখতে হাসপাতালে চলে গিয়েছেন। মাতৃহারা হয়েছেন পশ্চিম বর্ধমান জেলা কংগ্রেসের সভাপতি দেবেশ চক্রবর্তী। দিলীপ তাঁর বাড়িতে শোক জানাতে চলে গিয়েছেন।
তবে মুখকে বশে আনতে পারেননি এখনও। মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কে বেশ কিছু মন্তব্য করায় বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব শো-কজ় নোটিস ধরায় তাঁকে। নির্বাচন কমিশনও তৃণমূলের অভিযোগ পেয়ে দিলীপকে শো-কজ় করে। জোড়া শো-কজ়ের পরেও যে দিলীপ চুপ করেছেন তা নয়। গদা থেকে হকি স্টিক সবই হাতে নিয়েছেন আর চোখা চোখা কথায় আক্রমণ করেছেন তৃণমূলকে। দল বহিষ্কার করেছে এমন নেতাকে নিয়ে চা-চক্র বসিয়ে বিতর্কেও জড়িয়েছেন।
বিজেপি নেতৃত্ব ঠিকই বুঝেছিলেন যে, কীর্তির মোকাবিলায় দিলীপকে দরকার। আবার দিলীপ ওই আসনে যেতে পারেন জল্পনা থেকে কীর্তিকে পাঠিয়ে বুদ্ধিমত্তা দেখিয়েছে তৃণমূল। প্রচার জুড়ে দিলীপকে ‘মহিষাসুর’ বলে চলেছেন কীর্তি। মহিলাদের চণ্ডীরূপ ধরতেও বলেছেন। আর দিলীপ? ‘বাণী-ওস্তাদ’-এর বাণী, ‘‘উনি কে হরিদাস পাল! বর্ধমানের কে? কাছা খুলে দেবে এখানকার লোক।’’
বর্ধমান-দুর্গাপুর আসনে তাই কে জিতবে, কে হারবে, সেই প্রশ্নের সঙ্গে আরও একটা জবাব চায় রাজ্য রাজনীতি। ফলঘোষণার দিন কোন ‘কথাশিল্পী’ মুখে কুলুপ আঁটবেন?