• ইতিহাসের তমলুকে গোলমেলে ভোটের অঙ্ক, অভিজিৎ যা-ই করুন, ‘হার-জিত’ হবে সেই অধিকারী শুভেন্দুর
    আনন্দবাজার | ৩১ মে ২০২৪
  • নীলবাড়ির লড়াইয়ে সরাসরি প্রার্থী ছিলেন শুভেন্দু অধিকারী। উল্টো দিকে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই কারণে ২০২১ সালে নন্দীগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্র ‘ভিআইপি আসন’ হয়ে গিয়েছিল। এ বার যেমন হয়েছে তমলুক। এই আসন অতীতে শুভেন্দুর জেতা। কিন্তু সে অর্থে ‘ভিআইপি আসন’ ছিল না। এ বার কিন্তু রাজ্য রাজনীতির অন্যতম আগ্রহের কেন্দ্র দীর্ঘ সময় ধরে অধিকারী পরিবারের দখলে থাকা তমলুক লোকসভা। এই আসনে শুভেন্দু হেরেছেন এক বার। জিতেছেন দু’বার। পরে দু’বার জিতিয়েছেন তাঁরই ভাই দিব্যেন্দু অধিকারীকে।

    দিব্যেন্দু এই লোকসভা ভোটের আগে আগেই বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু আর টিকিট পাননি তমলুকের। পরিবর্তে মনোনয়ন পেয়েছেন শুভেন্দুরই ‘পছন্দের প্রার্থী’ কলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। যিনি একই সঙ্গে ‘বিতর্কিত’ও বটে। বিচারপতির চেয়ারে বসে বিভিন্ন মামলায় তিনি যে সব মন্তব্য করেছিলেন বা নির্দেশ দিয়েছিলেন, তার জেরে সমাজের একটি অংশের কাছে এতটাই জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন যে, অনেকে অভিজিৎকে ‘ঈশ্বর’ বা ‘ভগবান’ মনে করতে শুরু করেছিলেন। সেই ভাবমূর্তির মধ্যেই বিচারপতির পদে ইস্তফা দিয়ে রাতারাতি রাজনীতিতে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তমলুকের বিজেপি প্রার্থী হিসাবে নাম ঘোষণা। ঘটনাপরম্পরা দেখে রাজ্যের শাসক শিবির মনে করেছে, আগে থেকেই সব ঠিক করা ছিল।

    ভোটের প্রচারে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে ‘কুমন্তব্য’ করেছেন প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ। সে কারণে নির্বাচন কমিশন তাঁকে ‘শো-কজ়’ করেছে। তাঁর জবাবে সন্তুষ্ট না হয়ে ২৪ ঘণ্টার জন্য প্রচারে নিষেধাজ্ঞাও জারি করেছে। কমিশনের ‘রায়’ তিনি শুনেছেন। যদিও আসল ‘রায়’ তিনি শুনবেন আগামী ৪ জুন। জনতার রায়।

    তবে অভিজিৎ হারুন বা জিতুন, তমলুক লোকসভা আসনে আসল পরীক্ষা শুভেন্দুর। গত ১৫ বছর ধরে এই আসন অধিকারী পরিবারের হাতে। পাশাপাশিই, এই লোকসভা আসনের অন্তর্গত একটি বিধানসভা নন্দীগ্রাম। যেখানে মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে হারিয়ে শুভেন্দু বিধায়ক এবং রাজ্যের বিরোধী দলনেতা। শুভেন্দু তাঁর রাজনৈতিক জীবনে অনেক মাইলফলক পার করেছেন। কিন্তু অনেকে মনে করেন, ২০২১ সালে নন্দীগ্রাম জয়ই তার মধ্যে সব চেয়ে ‘উল্লেখযোগ্য’। তবে শুভেন্দু ব্যক্তিগত ভাবে মনে করেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে হারানোর মতোই ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বামফ্রন্টের ভরা জমানায় সিপিএমের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা লক্ষ্মণ শেঠকে তমলুক আসনে হারানোও কম কৃতিত্বের ছিল না।

    প্রবীণ রাজনীতিক শিশির অধিকারীর মধ্যম পুত্র শুভেন্দু ছাত্রাবস্থা থেকেই রাজনীতির অঙ্গনে পা রেখেছিলেন। এর আগেও তিনি বিধায়ক হয়েছেন। ২০১৬ সালে তৃণমূলের টিকিটে। সেটি ছিল তাঁর ‘বাড়ির কেন্দ্র’ দক্ষিণ কাঁথি থেকে। লক্ষ্মণের বিরুদ্ধে মমতাই ২০০৪ এবং ২০০৯ সালে শুভেন্দুকে ভোটের ময়দানে নামিয়েছিলেন। ২০০১ সালে বামফ্রন্টের মৎস্যমন্ত্রী কিরণময় নন্দের বিরুদ্ধে মুগবেড়িয়া (অধুনাবিলুপ্ত) থেকে প্রার্থী হয়ে পরাজিত হন শুভেন্দু। ২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ৫৭ হাজার ভোটে হারেন তমলুক লোকসভায়। তবে দ্বিতীয় বার ২০০৯ সালে পৌনে দু’লাখ ভোটে হারান লক্ষ্মণকে। ২০০৯ সালে তমলুকে ৫৫.৫৪ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন শুভেন্দু। ২০১৪ সালে সেই তমলুকে শুভেন্দু জেতেন ২ লক্ষ ৪৬ হাজার ভোটে। তবে ২০১৬ সালে মমতা শুভেন্দুকে রাজ্য মন্ত্রিসভায় নিতে চেয়ে তাঁকে টিকিট দেন নন্দীগ্রাম বিধানসভায় কেন্দ্রে। শুভেন্দু জেতেন। তাঁর ছেড়ে আসা তমলুক লোকসভায় উপনির্বাচনে জেতেন অধিকারী পরিবারের সদস্য, শুভেন্দুর ভাই দিব্যেন্দু। ২০১৬ সালের সেই ভোটে তাঁর জয়ের ব্যবধান ছিল পাঁচ লাখের মতো।

    পরের বার ২০১৯ সালে দিব্যেন্দু জেতেন ১ লাখ ৯০ হাজার ভোটে। তবে সে বার দ্বিতীয় স্থানে সিপিএম নয়, ছিলেন বিজেপির সিদ্ধার্থশঙ্কর নস্কর। কিন্তু এ বার ভোটের হিসাব কী করে হবে? মুশকিল একটাই। শুভেন্দু বা দিব্যেন্দুর পাওয়া ভোটের কোনটা ব্যক্তি হিসেবে প্রার্থীর আর কোনটা দল হিসেবে তৃণমূলের, তা ভাগ করবে কে? তবে অনেকে একটা হিসাব কষছেন গত বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল ধরে।

    বিধানসভা এবং লোকসভা ভোট একই ধারায় না হলেও তা থেকে কিছুটা আন্দাজ পেতে চেষ্টা করেন উৎসাহীরা। নীলবাড়ির লড়াইয়ে বিজেপি জিতেছিল ময়না, হলদিয়া এবং নন্দীগ্রাম আসন। অন্য দিকে তৃণমূল জেতে চারটি আসনে— তমলুক, পাঁশকুড়া পূর্ব, নন্দকুমার এবং মহিষাদল। সেই হিসাব বলছে বিজেপি পিছিয়ে। তমলুক লোকসভা আসনে তৃণমূল এগিয়ে ২৪ ভোটে।

    এই ২৪ ভোটের পাশে একাধিক শূন্য বসানোর দায়িত্ব দেবাংশু ভট্টাচার্যের। তৃণমূলের এই তরুণ নেতা রাজ্যের মুখপাত্রের পাশাপাশি শাসকদলের সমাজমাধ্যম দেখার প্রধান দায়িত্বে। নীলবাড়ির লড়াইয়ে তৃণমূলের হয়ে ‘খেলা হবে’ গানের গীতিকার বলে পরিচিত দেবাংশুর হাতে সত্যিই গুরুদায়িত্ব দিয়েছে তৃণমূল। কারণ, প্রার্থী যিনিই হোন, আসলে তমলুকে লড়ছেন নন্দীগ্রামে মুখ্যমন্ত্রীকে হারানো শুভেন্দু। যা ২০২১ সালের ভোটে বিপুল জয়ের পরেও তৃণমূলের কাছে ‘কাঁটা’ হয়ে রয়েছে।

    ব্রিটিশ ভারতেই স্বাধীন তাম্রলিপ্ত সরকার গঠন হয়েছিল। সেই আন্দোলনে যুক্ত সতীশচন্দ্র সামন্ত ১৯৫২ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত সাংসদ থেকেছেন তমলুকে। এর পরে এক বারের জন্য জনতা পার্টির সাংসদ হন স্বাধীনতা সংগ্রামী সুশীলকুমার ধাড়া। তার পরে রাজ্যের অন্যান্য এলাকার মতো ‘লাল’ হয়ে যায় তমলুকও। ১৯৯৬ সালে কংগ্রেসের জয় ছাড়া প্রতি বারেই তমলুকে জিতেছে সিপিএম। কিন্তু ২০১৯ সালে কমতে কমতে বামেদের ভোট হয়ে যায় ৯.১১ শতাংশ। সে বার আবার ‘লাল’ লক্ষ্মণ ‘সবুজ’ হয়ে কংগ্রেস প্রার্থী হয়েছিলেন। পেয়েছিলেন মাত্র ১.১১ শতাংশ ভোট।

    ফলে প্রায় ১০ শতাংশের মতো ভোটকে পুঁজি করেই সিপিএম প্রার্থী তরুণ আইনজীবী সায়ন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লড়তে গিয়েছেন তমলুকে। হতে পারে তাঁকে কেউ হিসেবের মধ্যে আনছেন না। কিন্তু বিজেপি প্রার্থী অভিজিৎ দাবি করছেন, প্রচারে দেবাংশুর থেকে তিনি বেশি দেখছেন সায়নকে।

    তবে তমলুক অন্য ফল দেখার অপেক্ষায়। যে ফলাফলে এক জনের জয়-পরাজয়ে রাজনৈতিক জীবনের লেখচিত্র বদলে যাবে অন্য এক জনের।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)