ভোটের দিন গড়বেতার মঙ্গলাপোতায় এসে 'আক্রান্ত' হয়েছিলেন ঝাড়গ্রামের বিজেপি প্রার্থী প্রণত টুডু। তিনি ছাড়াও জখম হয়েছিলেন তাঁর দুই দেহরক্ষী সিআইএসএফ জওয়ান-সহ বিজেপির কয়েকজন কার্যকর্তা। পাল্টা প্রার্থীর বিরুদ্ধেই মহিলাদের মারধর করার অভিযোগ তুলেছিল তৃণমূল। উভয় পক্ষই পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ করে। প্রণত-সহ কয়েকজন বিজেপি নেতার বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা রুজু করে পুলিশ। দুই অভিযোগেরই তদন্ত চললেও এখনও পর্যন্ত কেউ গ্রেফতার হয়নি। তবে ভোটের দিনে মঙ্গলাপোতার ঘটনা নিয়ে চর্চা থেমে নেই গেরুয়া শিবিরে। মার খেয়ে বাজিগর হবেন, না মঙ্গলাপোতার ঘটনা বিজেপি প্রার্থীর কাছে বুমেরাং হবে, তা নিয়ে অব্যাহত পদ্ম আলোচনা।
গড়বেতার ১ ব্লকের মঙ্গলাপোতা খড়কুশমা অঞ্চলের মধ্যে পড়ে। বগড়ি রাজদের রাজবাড়ি এখনও আছে মঙ্গলাপোতায়। এখানেই ২০০ নম্বর বুথে ভোটের দিন দুপুরে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে। এই বুথে মোট ভোটার ৭৫২ জন, এ বার ভোট পড়েছে ৫৭৪। এই বুথ-সহ মঙ্গলাপোতায় কয়েকটি বুথে ভোট দানে বাধা দেওয়া হচ্ছে, এই খবর পেয়ে দলের কয়েকজন কার্যকর্তাকে নিয়ে এলাকায় আসেন বিজেপি প্রার্থী প্রণত। ২০০ নম্বর মঙ্গলাপোতা এসএসকে বুথে কয়েকজন ভোটারকে বুথে ঢুকিয়ে তিনি যখন ফিরছিলেন সেইসময়ই তাঁর উপর 'হামলা' হয় বলে অভিযোগ। ভাঙচুর করা হয় প্রার্থীর গাড়িও। এ নিয়ে শোরগোল পড়ে রাজ্য রাজনীতিতে। ঘটনার পর অ্যাকশন টেকেন রিপোর্ট চায় নির্বাচন কমিশন।
ভোটের দিন মঙ্গলাপোতার ঘটনা না হলেই ভাল হত বলে মনে করছেন বিজেপি কর্মীদের একাংশ। তাঁদের ব্যাখ্যা, ভোটের দিনে সংখ্যালঘু প্রধান খড়কুশমা অঞ্চলের মঙ্গলাপোতা এলাকার একটা বুথের ঘটনা নিয়ে অতটা সময় ব্যয় করা উচিত হয়নি দলীয় প্রার্থীর। কর্মীদের ওই অংশের আশঙ্কা, সে দিন দুপুর ২টা থেকে প্রায় সাড়ে ৫টা পর্যন্ত এই তিন -সাড়ে তিন ঘন্টা ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রার্থীর গড়বেতাতেই রয়ে যাওয়া শেষ পর্যন্ত বুমেরাং না হয়! তাঁদের যুক্তি, প্রার্থীর উপর হামলার খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে দলীয় কর্মীদের মধ্যে, এতে অনেকে আতঙ্কিত হয়ে শেষ পর্যন্ত বুথ আগলে পড়ে থাকার দম হারিয়ে ফেলতে পারেন, তার সুযোগ নিতে
পারে তৃণমূল।
তা ছাড়া দলের ওই অংশ মনে করাচ্ছেন, উনিশের লোকসভা ভোটেও মঙ্গলাপোতার এই বুথে দলীয় পোলিং এজেন্টকে বসাতে গিয়ে ‘আক্রান্ত’ হতে হয়েছিল এক বিজেপি নেতাকে। তার পরেও কেন ওই বুথে দলের প্রার্থীকে নিয়ে যাওয়া, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে দলের অন্দরেই। ঘটনার দিন বিকেলে কয়েকজন বিজেপি কার্যকর্তাও কার্যত একই যুক্তি দেন। বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে, ভোটের দিন মঙ্গলাপোতার ঘটনার পর নাগপুর থেকে আরএসএসের অখিল ভারতীয় কার্যকর্তা ও সঙ্ঘের ক্ষেত্র প্রচারকরা বিজেপি প্রার্থী আক্রান্তের খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করে ফোন করেন সঙ্ঘ ঘনিষ্ঠ এক বিজেপি নেতাকে। ওই নেতাকে সঙ্ঘ কর্তারা না কি ২০১৯ সালের ঘটনা মনে করিয়ে দিয়ে ওই বুথে এ বার যাওয়া উচিত হয়নি বলে জানান। যদিও সেই বিজেপি নেতা যুক্তি দিয়ে দলের 'কৌশল' বোঝান সঙ্ঘ কর্তাদের।
কী কৌশল? সেদিন প্রণতের সঙ্গে ‘আক্রান্ত’ হয়েছিলেন বিজেপির এসসি মোর্চার রাজ্য সাধারণ সম্পাদক মদন রুইদাস। তিনি বলেন, ‘‘মঙ্গলাপোতা সহ খড়কুশমা অঞ্চল সন্ত্রস্ত, সংখ্যালঘু প্রধান এলাকা। সেখানে আমাদের ভোট আছে, কিন্তু সব বারেই তাঁদের ভোটে বাধা দান করা হয়। এর একটা স্থায়ী প্রতিকার দরকার ছিল। যাতে সর্বোচ্চ প্রশাসনের নজর পড়ে সে জন্য এ বার বাধা আসতেই প্রার্থীকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সেখানে।’’সেই কৌশলই যদি হবে তাহলে প্রার্থীর অভিযোগ পত্রে নির্দিষ্ট করে শাসকদলের কারও নাম নেই কেন? উল্টে প্রার্থীর বিরুদ্ধেই জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা হল কেন? এক বিজেপি নেতা বলছেন, ‘‘গোলমালের মধ্যে চেনার ফুরসত ছিল না। তবে তৃণমূল যে করেছে এটা নিশ্চিত। সেটা ঢাকতেই দেওয়া হয়েছে জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা,
যা ভাঁওতা।’’ যদিও ঝাড়গ্রাম কেন্দ্রের গেরুয়া শিবিরের একটা বড় অংশ বলছে, মার খেয়ে বাজিগর হবেন দলের প্রার্থী প্রণত। ঝাড়গ্রাম মেডিক্যালের সরকারি চিকিৎসকের চাকরি ছেড়ে ভোটে লড়ছেন প্রণত। এই ক’দিনে স্বল্পভাষী প্রণত রাজনীতির আদব-কায়দা রপ্ত করেছেন। তাঁর ভূমিকা নিয়ে সন্তুষ্ট সঙ্ঘও। ঝাড়গ্রামে সঙ্ঘের এক কার্যকর্তা বলছেন, ‘‘রাঢ়বঙ্গের তরুণ-লড়াকু চিকিৎসক প্রণত টুডুর সাংগঠনিক ও সামাজিক দূরদর্শিতা রয়েছে। উনি দীর্ঘ রেসের ঘোড়া। তাঁর ভূমিকা যথেষ্ট সন্তোষজনক।’’
ঝাড়গ্রাম লোকসভায় বিপুল ভোটদানের হার দেখে সঙ্ঘের ঝাড়গ্রাম লোকসভা কেন্দ্রিক জাগরণ প্রমুখ তথা আইনজীবী উত্তম বেজ বলছেন, ‘‘জাতিগত বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনগুলিও রাষ্ট্র নির্মাণের হিতে ভোট দানে সদর্থক ভূমিকা নিয়েছেন। মানুষ নীরবে শান্তিপূর্ণ ভাবে নিজের মত প্রকাশে ভোটদান করেছেন।’’ সঙ্ঘের পর্যবেক্ষণ, ঝাড়গ্রামের রাষ্ট্রবাদী ভোটাররা প্রণতকে নিরাশ করবেন না।
এ বার ভোটে বিজেপির জেলা সভাপতি তুফান মাহাতোর সঙ্গে মাঠে নেমেছিলেন প্রাক্তন জেলা সভাপতি তথা বর্তমান রাজ্য কমিটির সদস্য সুখময় শতপথী। তিনি বলছেন, ‘‘লোকসভার ২০১৮ টি বুথের মধ্যে কয়েকটি বুথ বাদে বাকি সব বুথে আমাদের পোলিং এজেন্ট ছিল। ফর্ম-১৭সি পাওয়ার পর আমাদের পর্যবেক্ষণ, প্রতি বুথে আমরা গড়ে চারশো ভোট পেয়েছি। আমাদের প্রার্থী জয়ের দৌড়ে এগিয়ে আছেন।’’ সুখময়ের ভবিষ্যতবাণী, ‘‘ব্যবধান যাই হোক না কেন, তাঁদের প্রার্থীর জয় নিশ্চিত।’’