‘মির্জাপুর’ ওয়েবসিরিজ়ে কলিন ভাইয়াকে তাঁর বাবুজি পরামর্শ দিয়েছিলেন, সে যদি মির্জাপুরের সঙ্গে জৌনপুরের ‘কন্ট্রোল’ও নিতে নিতে পারে, তা হলে গোটা পূর্বাঞ্চল হাতে চলে আসবে।
লোকসভা নির্বাচনের শেষ দফা ভোটের আগে বিজেপির একটাই চিন্তা। কী ভাবে বিজেপি উত্তরপ্রদেশের পূর্বাঞ্চল-এর ‘কন্ট্রোল’ নেবে? বারাণসীর ঝাঁ চকচকে বিজেপি দফতরে বারবার প্রশ্নটা ভেসে উঠছিল। এই দফতর থেকেই আপাতত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সংসদীয় দফতরের কাজকর্ম চলছে। সেখানেও বিজেপি নেতাদের মধ্যে একটাই আলোচনা— বারাণসীতে বৈতরণী পার হওয়ার চিন্তা নেই। কিন্তু তারপরে? বাকি পূর্বাঞ্চলে কী হবে?
খোদ মোদীর লোকসভা কেন্দ্র বারাণসী। সেই বারাণসীর বিজেপি দফতরে এত দুশ্চিন্তা কীসের? কারণ একটাই। গোটা উত্তরপ্রদেশে এই পূর্বাঞ্চল বা উত্তরপ্রদেশের পূর্ব দিকের লোকসভা কেন্দ্রগুলিতেই সবথেকে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি বিজেপি ও তার শরিক দল। উত্তরপ্রদেশে এ বার বিজেপি ৮০টি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে ৮০টিই জেতার লক্ষ্য নিয়েছিল। গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি তথা এনডিএ জিতেছিল ৬৪টি আসন। তার মধ্যে বিজেপি জিতেছিল ৬২টি আসন। তবে এ বার এনডিএ ৬৪টি আসন ধরে রাখতে পারবে কি না, তা বলে দেবে পূর্বাঞ্চল।
পাঁচ বছর আগে বারাণসীতে বিজেপি বিপুল ভোটে জিতেছিল ঠিকই। কিন্তু তার আশেপাশের প্রায় আধ ডজন আসনে বিজেপি ও তার শরিক দলের সঙ্গে সমাজবাদী পার্টি-বহুজন সমাজ পার্টির জোটের ‘কাঁটে কা টক্কর’ হয়েছিল। এ বার পূর্বাঞ্চলের অধিকাংশ লোকসভা কেন্দ্রের হাওয়া বলছে, কে জিতবে, কে হারবে, তা এখনও নিশ্চিত নয়! বিজেপি ও তার শরিক, আপনা দল ও সুহেলদেব ভারতীয় সমাজ পার্টি পূর্বাঞ্চলে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি।
কারণ? বারাণসী শহর থেকে বেরোলেই টের পাওয়া যাচ্ছে, বেকারত্ব এখানে বড় প্রশ্ন। কাজের সুযোগ নেই। কারখানা নেই। সরকারি চাকরির সুযোগ কমেছে। বারাণসী স্টেশনে দিল্লি যাওয়ার ট্রেনের অপেক্ষায় থাকা প্রতাপ রাজভড় ক্ষোভ উগরে দিলেন। আগে সেনায় চাকরির জন্য রোজ সকালে মাঠে দৌড়তেন। মোদী সরকার সেনায় মাত্র চার বছরের জন্য নিয়োগে অগ্নিবীর প্রকল্প চালু করেছে। তার পরে বিরক্তিতে সেনায় চাকরির প্রস্তুতি বন্ধ করে দিয়েছেন রাজভড়। এখন দিল্লি চলেছেন অন্য সরকারি চাকরির প্রস্তুতির জন্য কোচিংয়ের খোঁজ নিতে।
বড় হয়ে উঠছে জাতপাতের সমীকরণ। মায়াবতী মাঠে নেই। তিনি বিভিন্ন লোকসভা কেন্দ্রে ভোট কাটার প্রার্থী দিয়ে রেখেছেন বলে অভিযোগ। মায়াবতীর প্রতি বিরূপ দলিত ভোট সমাজবাদী পার্টি-কংগ্রেসের জোটকে বিকল্প হিসেবে দেখতে চাইছে।
এমনিতে বারাণসীর আশেপাশেও ভিআইপি লোকসভা কেন্দ্রের কমতি নেই। চন্দৌলি থেকে লড়ছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মহেন্দ্র নাথ পাণ্ডে। মির্জাপুর থেকে আপনা দলের নেত্রী অনুপ্রিয়া পটেল। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখরের ছেলে নীরজ শেখর বালিয়া থেকে প্রার্থী। সুহেলদেব ভারতীয় সমাজ পার্টির প্রধান, উত্তরপ্রদেশ সরকারের মন্ত্রী ওমপ্রকাশ রাজভড়ের ছেলে অরবিন্দ ঘোসি থেকে প্রার্থী হয়েছেন।
জাতপাতের সমীকরণে বিজেপিকে বিপাকে ফেলতে অখিলেশ যাদব পূর্বাঞ্চলে সমাজবাদী পার্টির হয়ে শুধু যাদব নন, বিজেপি থেকে আসা দলিত নেতাদেরও প্রার্থী করেছেন। বিজেপি নেতারা বলছেন, ‘‘আমরা বুঝতে পারছি, অখিলেশ জাতপাতের সমীকরণে জিততে চাইছেন। এ বার সামগ্রিক ভাবে নরেন্দ্র মোদীর হাওয়া নেই। জাতীয়তাবাদের আবেগ নেই। ফলে জাতপাতের সমীকরণ বড় হয়ে উঠছে। মোদী সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের সুবিধাপ্রাপ্তদের সামনে রেখে আমরা ভোট কুড়োতে চাইছি। কিন্তু কংগ্রেস নানা রকম গ্যারান্টি ঘোষণা করে সেই ভোটে ভাগ বসাতে চাইছে।’’
লোকসভা ভোটের গোড়াতেই নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, তাঁর কাছে চারটিই জাত। তরুণ, মহিলা, কৃষক ও গরিব। উল্টো দিকে, অখিলেশ যাদবের অঙ্ক হল, পিডিএ ভোট—পিছড়ে বা অনগ্রসর, দলিত এবং অল্পসংখ্যক বা সংখ্যালঘু মুসলিম। সমাজবাদী পার্টির নেতা আশিস যাদবের যুক্তি, ‘‘বিজেপি গত কয়েক বছরে যাদব ছাড়া অন্যান্য ওবিসি ভোটব্যাঙ্ক এবং মায়াবতীর নিজস্ব জাটভ সম্প্রদায় ছাড়া অন্যান্য দলিত ভোটব্যাঙ্কে ভাগ বসাতে চেয়েছে। এ বার ওবিসি ও দলিত ভোটব্যাঙ্ক কোন দিকে যাচ্ছে, সেটাই পূর্বাঞ্চলের ভাগ্য ঠিক করে দেবে।’’ শুধু পূর্বাঞ্চল নয়, সামগ্রিক ভাবে উত্তরপ্রদেশ এবং হয়তো গোটা দেশের লোকসভা ভোটের ফলও।