• শুভেন্দু না অভিষেক, কোন সেনাপতি শেষ হাসি হাসবেন দিল্লিবাড়ির লড়াইয়ে? মঙ্গলে জেনে যাবেন বঙ্গবাসী
    আনন্দবাজার | ০৩ জুন ২০২৪
  • প্রথমজন বলছেন, তাঁদের দল ব্যক্তিবাদে বিশ্বাস করে না। ভোটের ফলাফল যা হবে, সেটা দলের। দ্বিতীয়জন হাসতে হাসতে বলেছেন, তিনি সেই ২০২১ সাল থেকেই পরীক্ষা দিচ্ছেন! বিধানসভা ভোটের পরে পঞ্চায়েত ভোট। তার পরে লোকসভা ভোট। রাজনীতি করলে পরপর পরীক্ষা দিয়েই যেতে হবে।

    প্রথমজন বলছেন, তাঁদের দল গত লোকসভা ভোটের চেয়ে ভাল ফল করবে। দ্বিতীয়জন বলছেন, গত লোকসভা ভোটের চেয়ে একটি হলেও তাঁদের আসন বাড়বে।

    দু’জনেই গত তিন মাস অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। দু’জনেই লোকসভা ভোটের প্রচারে রাজ্যের এমুড়ো-ওমুড়ো দৌড়ে বেড়িয়েছেন। দু’জনেই দলের প্রার্থী বাছাইয়ের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন। দলের বিবিধ ভোটকৌশল ঠিক করেছেন। দু’জনেই নিজ নিজ শিবিরের হয়ে পরীক্ষায় বসেছিলেন। মঙ্গলবার সেই পরীক্ষার ফল প্রকাশ হবে। পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি লোকসভা আসনের ফলাফল ঠিক করে দেবে দুই শিবিরের দুই সেনাপতির ভবিষ্যৎ রাজনীতির পথ।

    দু’জনে একদা একই দলে ছিলেন। এখন দু’জন দুই শিবিরের সেনাপতি। প্রথমজন যুদ্ধ করছেন নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের অধীনে। দ্বিতীয়জন যুদ্ধে নেমেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অধীনে। মঙ্গলবার ভোটের ফলাফল ঠিক করে দেবে দুই সেনাপতির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ।

    প্রথমজন শুভেন্দু অধিকারী। দ্বিতীয়জন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলার লোকসভা ভোটের লড়াই আপাতদৃষ্টিতে মোদী-দিদি হলেও আসলে যুদ্ধ শুভেন্দু-অভিষেকের। দিল্লিবাড়ির এই লড়াই তাঁদের আগামী দু’বছরের ইতিকর্তব্যও স্থির করে দেবে। ঠিক করে দেবে, ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটে তাঁরা কে কোন ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন।

    সমাবেশ এবং রোড-শো মিলিয়ে প্রচারপর্বে অভিষেক গিয়েছেন ৭২টি জায়গায়। শুভেন্দু ১৪৮টি জায়গায় সমাবেশ এবং রোড-শো করেছেন। তবে অভিষেক নিজে প্রার্থী হওয়ায় তাঁকে নিজের কেন্দ্রেও সময় দিতে হয়েছে। উপরন্তু, অভিষেক গোটা প্রচারপর্বেই প্রতিদিন প্রচার সেরে কলকাতায় ফিরে নিজের দফতরে সাংগঠনিক কাজে ব্যস্ত থেকেছেন। শুভেন্দুর নিজের ভোট এ বার ছিল না। তবে কাঁথি এবং তমলুকে দলীয় প্রার্থী অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় এবং সহোদর সৌমেন্দু অধিকারীর ‘ভার’ তাঁরই কাঁধে।

    পাঁচ বছর আগে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে শুভেন্দু-অভিষেক দু’জনেই ছিলেন তৃণমূলে। ফলে দু’জনের লক্ষ্য ছিল এক। অভিষেক তখন সাংসদ থাকলেও শুভেন্দু ছিলেন না। ডায়মন্ড হারবারে নিজের জয় নিশ্চিত করা আর ব্যবধান বাড়ানোই ছিল অভিষেকের লড়াই। ব্যবধান প্রায় পাঁচ গুণ বাড়িয়ে ভবিষ্যতের সেনাপতি জিতেছিলেন ৩ লাখ ২০ হাজারেরও বেশি ভোটে। শুভেন্দু তখন রাজ্যের মন্ত্রী। তিনি দায়িত্বে ছিলেন মুর্শিদাবাদ-মালদহের। সঙ্গে দক্ষিণবঙ্গের জঙ্গলমহলেরও। যদিও তৃণমূলে থাকাকালীনই দু’জনের মধ্যে যোজন দূরত্ব তৈরি হয়েছিল।

    সেই লোকসভা ভোটে তৃণমূলের বিপর্যয়ই হয়েছিল। কিন্তু তৎসত্ত্বেও তারা বিজেপির চেয়ে বেশি আসনেই জিতেছিল। বিজেপি পেয়েছিল ১৮টি আসন। তৃণমূল ২২টি। বাকি দু’টি কংগ্রেস।

    এ বার অবশ্য পরিস্থিতি পুরোপুরি বদলে গিয়েছে। যে বদলের সূচনা হয়েছিল ২০২১ সালের নীলবাড়ির লড়াই থেকে। তখন থেকেই শুভেন্দু-অভিষেক যুযুধান। যদিও ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের লড়াইয়ে শেষ হাসি হেসেছিলেন অভিষেকই। ‘নীলবাড়ি’ নবান্ন দখল করতে নেমে শুভেন্দু ‘যাদুসংখ্যা’র ধারেপাশে পৌঁছতে পারেননি। যদিও বিজেপির আসন ৩ থেকে বেড়ে ৭৭-এ পৌঁছেছিল। পক্ষান্তরে, মমতার অধিনায়কত্বে অভিষেক বেনজির ফল করেছিলেন। বিপুল গরিষ্ঠতা নিয়ে তৃতীয় বারের জন্য রাজ্যের ক্ষমতায় এসেছিল তৃণমূল।

    এ বার দিল্লিবাড়ির লড়াইয়ে প্রার্থী বাছাইয়ে দুই সেনাপতিই ‘স্বাধীনতা’ পেয়েছেন। রাজ্য জুড়ে বিজেপির প্রার্থী দেওয়ার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নিয়েছেন বটে। কিন্তু তাতে শুভেন্দুর সরবরাহ-করা তথ্যেরও প্রভাব থেকেছে। বিজেপির অন্দরে অনেকেই মনে করেন, দিলীপ ঘোষের কেন্দ্র বদলে যাওয়া বা বসিরহাটে ‘নির্যাতিতা’ রেখা পাত্রকে প্রার্থী করা অথবা তমলুকে প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে প্রার্থী করার ক্ষেত্রে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দুর বক্তব্য গুরুত্ব পেয়েছে। যদিও আসানসোলে জিতেন্দ্র তিওয়ারিকে চেয়েও প্রার্থী করতে পারেননি শুভেন্দু। কারণ, জিতেন্দ্র ভোটের আগে এক অবাঞ্ছিত বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু সারা রাজ্যে মোটামুটি শুভেন্দুর যুক্তিই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। হিরণ চট্টোপাধ্যায়, মনোজ টিগ্গা, অগ্নিমিত্রা পালেদের মতো বিধায়কেরা ছাড়াও টিকিট পেয়েছেন স্বপন মজুমদার, গৌরীশঙ্কর ঘোষ, অসীম সরকারেরা। পরিষদীয় দলের এই সদস্যদের লোকসভা ভোটে প্রার্থী করার পরিকল্পনা শুভেন্দুরই মস্তিষ্কপ্রসূত বলে বিজেপির অন্দরের খবর। হাওড়ার রথীন চক্রবর্তী, বোলপুরের পিয়া সাহার নামও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে দেওয়া শুভেন্দুর তালিকায় ছিল। তৃণমূল থেকে বিজেপিতে আসা তাপস রায় কলকাতা উত্তরে প্রার্থী হয়েছেন। দমদমে টিকিট পেয়েছেন শীলভদ্র দত্ত, ব্যারাকপুরে অর্জুন সিংহ। এঁদের সঙ্গে শুভেন্দুর সম্পর্কের কথা সর্বজনবিদিত।

    তৃণমূলের ক্ষেত্রেও প্রার্থী বাছাইয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অভিষেকের অভিমত গুরুত্ব পেয়েছে। দলের ‘সাংগঠনিক প্রধান’ হিসেবে অভিষেককে মমতা সে ‘স্বাধীনতা’ দিয়েছিলেন বলেই রাজ্যের শাসক শিবির সূত্রের খবর। যদিও অনেকেই মনে করেন, দলের অন্দরে নবীন-প্রবীণ ‘দ্বন্দ্বের’ ছায়া পড়েছে প্রার্থিতালিকায়। যে ধারনার সমর্থন মিলেছে অভিষেক তিন ‘প্রবীণ’ সৌগত রায়, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কেন্দ্রে প্রচারে না-যাওয়ায়। কিন্তু একইসঙ্গে তৃণমূলের প্রার্থিতালিকায় সায়নী ঘোষ, দেবাংশু ভট্টাচার্য, শাহনওয়াজ আলি রায়হান, প্রকাশ চিক বরাইকরাও প্রার্থী হয়েছেন। বাদ পড়েছেন নুসরত জাহান, অপরূপা পোদ্দারেরা। অভিনেত্রী মিমি চক্রবর্তী আগেই ভোটে না-দাঁড়ানোর ইচ্ছা প্রকাশ করে সরে গিয়েছিলেন। সরে না-গেলে তিনি টিকিট পেতেন, এমন কোনও নিশ্চয়তা তৃণমূলের অন্দরে শোনা যায়নি। কারণ, অভিষেক বরাবর চেয়েছেন, দলের কাজে পর্যাপ্ত সময় যাঁরা দিতে পারবেন, তাঁদেরই প্রার্থী করা হবে। অর্থাৎ, পেশাগত ভাবে যে যা-ই করুন, রাজনীতিটা সর্বক্ষণের জন্য করতে হবে। তবে এর ব্যতিক্রমও ছিল। বীরভূমে শতাব্দী রায় বা ঘাটালের দেবকে অভিষেক প্রার্থী রাখতে চেয়েছিলেন।

    তৃণমূলের প্রচারের নকশাও অভিষেকেরই তৈরি। ব্রিগেড সমাবেশ থেকে দলের প্রার্থিতালিকা ঘোষণা করা, সমস্ত প্রার্থীকে একযোগে র‌্যাম্পে হাঁটানো থেকে শুরু করে ‘জনগর্জন’-এর ‘থিম সঙ্গীত’ তৈরি— সবেতেই অভিষেকের ‘ছাপ’ স্পষ্ট। বহরমপুরে তাঁর ‘চমকপ্রদ’ বাছাই ইউসুফ পাঠান বহু যুদ্ধের প্রবীণ অধীর চৌধুরীকে হারিয়ে দিতে পারলে ‘সেনাপতি’ অভিষেকের ‘ক্যাপ্টেন’ হয়ে ওঠা সহজতর হবে।

    মঙ্গলবারের ফলাফল বলে দেবে শুভেন্দু না অভিষেক— কে হবেন ‘লম্বা রেসের ঘোড়া’!
  • Link to this news (আনন্দবাজার)