তিনি যা বলেছিলেন, হুবহু সেটাই মিলল। বুথফেরত সমীক্ষা যখন দেখিয়েছিল, বাংলায় তৃণমূলের ‘ভরাডুবি’ হতে চলেছে, তখন দলের প্রার্থী, জেলা সভাপতিদের নিয়ে বৈঠক করে তিনিই বলেছিলেন, ‘চোয়াল শক্ত’ রাখতে। তৃণমূল কমবেশি ৩০টা আসন জিতবে। নিজের ভবিষ্যদ্বাণী মিলিয়ে দেওয়ার পাশাপাশিই তিনি সম্মুখসমরে পাঁচ গোল মেরেছেন শুভেন্দু অধিকারীকে। ‘সেনাপতি’ থেকে হয়ে উঠেছেন ‘ক্যাপ্টেন’।
মঙ্গলবার দিল্লিবাড়ির লড়াইয়ে যে ফলাফল হল বাংলায়, তাতে ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের পরে আরও এক বার দলের অভ্যন্তরে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল সেনাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্ব। প্রতিষ্ঠিত হল সামগ্রিক ভাবে বাংলার রাজনীতিতেও। দেখা গেল কৌশল, সংগঠন, প্রচার, অভিমুখ নির্ধারিত করা— সব ক্ষেত্রেই বিজেপিকে কয়েক যোজন পিছনে ফেলে দিলেন অভিষেক। সে অর্থে তিনিই এই ভোটের আসল ‘হিরো’।
ভোটের প্রচার পর্বে অভিষেকের বক্তৃতায় নির্দিষ্ট ‘অভিমুখ’ ছিল। যে অভিমুখ কখনও ঘুরে যায়নি। দেখা গিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বা অমিত শাহেরা বাংলায় এসে তৃণমূলের বিরুদ্ধে যা যা বলেছিলেন, তার পাল্টা বলছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিষেক সে ভাবে মোদী-শাহদের জবাব দেওয়ার পথে হাঁটেননি। তিনি শুধু তুলনামূলক রাজনৈতিক পরিসংখ্যান তুলে ধরে আক্রমণ শানিয়েছিলেন বিজেপিকে। তাঁর বক্তব্যের মূল উপজীব্য ছিল— মমতার সরকার কী কী দিচ্ছে বাংলার জনগণকে। বাংলার মানুষের কী কী ‘প্রাপ্য’ আটকে রেখেছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। যে প্রাপ্য আদায়ের দাবি নিয়ে গত বছর সেপ্টেম্বরে দিল্লিতে আন্দোলন নিয়ে গিয়েছিলেন অভিষেক। তার পর রাজধানীতে ধর্না, অবস্থান-বিক্ষোভ, পুলিশি ধরপাকড় এবং শেষে কলকাতায় ফিরে রাজভবনের সামনে ধর্নায় বসে পড়া— অন্য অভিষেককে দেখেছিল বাংলা।
মাঝে বেশ কয়েক মাস খানিকটা নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিলেন অভিষেক। নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন নিজের লোকসভা কেন্দ্র ডায়মন্ড হারবারে। গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ফের সংগঠনের কাজে ফিরতে শুরু করেন তৃণমূলের সেনাপতি। প্রার্থী ঠিক করা, প্রচারের নকশা আঁকা, গোটা বাংলা ছুটে বেড়ানো— সবই করেছেন তিনি। অনেকের বক্তব্য, বিজেপির হয়ে অনেকটা একই রকম ভূমিকা নিয়েছিলেন শুভেন্দু অধিকারী। যে কারণে দু’জনের তুলনা আরও বেশি করে ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে প্রাসঙ্গিক হয়ে গিয়েছিল। দু’জনেরই পরীক্ষা ছিল এই ভোট। অভিষেক ফার্স্টর বয় হয়েছেন। শুভেন্দু ফেল!
ভোটের ফল নিয়ে দু’জনের দাবি প্রায় এক ছিল। শুভেন্দু বলেছিলেন, সংখ্যা তিনি বলবেন না। তবে তৃণমূলের থেকে একটি হলেও বেশি আসন পাবে বিজেপি। অর্থাৎ, তৃণমূল যদি ২০টি পায়, তা হলে বিজেপি অন্তত ২১টি আসন পাবে। অন্য দিকে, ষষ্ঠ দফার ভোটের পরে অভিষেক বলেছিলেন, ‘‘আগের বার ২২টা পেয়েছিলাম। পৃথিবী রসাতলে গেলও ২৩টা এ বার পাবই।’’ দেখা গেল অভিষেক তাঁর অনুমান বাস্তবায়িত করতে পেরেছেন।
অভিষেক নিজেও বিপুল ভোটে ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্রে জিততে চলেছেন। অভিষেকের নেতৃত্ব তথা তাঁর জয়ের ব্যবধান নিয়ে বিজেপির রাজ্য সভাপতি তথা বালুরঘাটে কঠিন লড়াইয়ের মুখোমুখি সুকান্ত মজুমদার বলেছেন, ‘‘ওঁর জয় বা ওঁদের দল নিয়ে আমি কিছু বলব না। ফল নিয়ে আমরা আমাদের দলে আলোচনা করব।’’ গণনা চলাকালীন সংবাদমাধ্যমকে এই কথা বলেন সুকান্ত।
২০২১ সালের বিধানসভা ভোট থেকেই অভিষেক সংগঠনে ‘বিশেষ’ ভূমিকা নেওয়া শুরু করেছিলেন। যদিও তখন তাঁর পাশে ছিলেন ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোর। কিন্তু এ বার তিনি নেই। তবে পেশাদার সংস্থা আইপ্যাক এই ভোটে কাজ করেছে। প্রার্থীচয়নে এই সংস্থার সমীক্ষাও বিশেষ ভূমিকা নিয়েছে। দেখা যাচ্ছে আরামবাগ, ঝাড়গ্রামের মতো আসনে চমকপ্রদ প্রার্থী দেওয়া তৃণমূলের জন্য কার্যকর হয়েছে। অন্য দিকে, দিলীপ ঘোষকে বর্ধমান-দুর্গাপুরের মতো আসনে লড়তে পাঠানো বা অগ্নিমিত্রা পালকে মেদিনীপুরে পাঠানোর শুভেন্দু-কৌশল কাজে আসেনি।
সন্দেশখালি এবং শেখ শাহজওয়ান নিয়ে যখন গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে রাজ্য রাজনীতি তোলপাড়, তখন অভিষেকই সামনে থেকে দলের লাইন ঠিক করে দিয়েছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা, সন্দেশখালির যে আখ্যান নিয়ে বিজেপি এবং তার সহযোগীরা ভোটের ময়দানে নেমেছিল, একটি ‘স্টিং ভিডিয়ো’ তা পুরোপুরি ঘুরিয়ে দিয়েছে। সমাজমাধ্যমের প্রচারেও অভিষেকের তৃণমূল অনেকটা এগিয়ে থেকেছে শুভেন্দুর আইটি সেলের থেকে। সন্দেশখালির গোপন ক্যামেরা অভিযানের ‘ফুটেজ’ নিয়ে তৃণমূলের আইটি সেল যে প্রচার করেছিল, তা-ও ধারণা নির্মাণে কাজ করেছে। বসিরহাট তো বটেই, সন্দেশখালি বিধানসভা কেন্দ্রেও জিতেছে তৃণমূল।
সবচেয়ে বড় বিষয় হল, শাসকদলের বিরুদ্ধে বিবিধ দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও ভোটের ফলে তার প্রভাব পড়েনি। ভোট শতাংশ বাড়িয়েছে জোড়াফুল শিবির। যা দলের গণভিত্তি কতটা মজবুত, তা বোঝার অন্যতম সূচক। দিল্লিবাড়ির লড়াইয়ের ফল বঙ্গ রাজনীতিতে অভিষেকের সেনাপতিত্বকে ‘প্রতিষ্ঠা’ দিল। প্রশ্নের মুখে পড়ে গেল শুভেন্দুর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ।