তিন ‘বহিরাগত’ কঠিন মাঠে ফোটালেন ঘাসফুল! পাঠান, শত্রুঘ্ন এবং কীর্তির কাছে ধরাশায়ী হল পদ্ম এবং হাত
আনন্দবাজার | ০৪ জুন ২০২৪
তৃণমূলের তিন ‘বহিরাগত’ প্রার্থীর কাছে পরাস্ত হল বিজেপি এবং কংগ্রেস। বহরমপুরে অধীর চৌধুরী হারলেন ইউসুফ পাঠানের কাছে। বর্ধমান-দুর্গাপুরে দিলীপ ঘোষের পরাজয় হল কীর্তি আজ়াদের হাতে। আর আসানসোলের মাটিতে দ্বিতীয় বার বিজেপিকে ‘খামোশ’ করলেন শত্রুঘ্ন সিন্হা।
বিজেপিকে ‘বাংলা বিরোধী’ এবং ‘বহিরাগত’ বলে তোপ দেগেছিল তৃণমূল। জনসভা থেকে যে সুর বেঁধে দিয়েছিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, সেটাই ‘বুমেরাং’ হয়ে ফিরে আসে তাঁর ত্রয়ী প্রার্থীর সৌজন্যে। পাঠান, শত্রুঘ্ন এবং কীর্তির মধ্যে প্রথম জন ক্রিকেটের মাঠে বড় ছক্কা হাঁকানোয় খ্যাত হলেও রাজনীতিতে নিখাদ আনকোরা। বাকি দু’জনের অবশ্য ভোটে লড়ার এবং সংসদে যাওয়া, দুই অভিজ্ঞতাই রয়েছে। তবে তিন জনেই ‘কঠিন ম্যাচ’ বার করে আনলেন। ভোটগণনার রাউন্ড যত এগিয়েছে, বহরমপুর থেকে বর্ধমান-দুর্গাপুর হয়ে আসানসোলে ‘খেলা হবে’ স্লোগান তত তীব্র হল। ভোটের ফল পরিষ্কার হতেই অভিষেকের মোবাইল নম্বর থেকে ‘কনগ্র্যাচুলেশন্স’ মেসেজ চলে যায় পাঠানের কাছে।
শত্রুঘ্ন ও কীর্তি আদতে বিহারের বাসিন্দা, ইউসুফ গুজরাতের। ওই তিন কেন্দ্রেই ঘাসফুল ফোটালেন তিন বহিরাগত। বহরমপুরের মতো কেন্দ্রে বিশ্বকাপজয়ী ক্রিকেট দলের সদস্য পাঠানকে প্রার্থী করে চমকই দিয়েছিল তৃণমূল। ব্রিগেডে প্রার্থিতালিকা ঘোষণার সময় ‘আচমকা’ ইউসুফের প্রবেশ এবং তার পর সোজা ‘অধীর গড়’ বহরমপুরে ‘খেলা’ কঠিন ছিল। কিন্তু ‘পিঞ্চ হিটার’ তা করিয়ে দেখালেন। গণনার প্রথম দিকে পাঁচ বারের সাংসদ কংগ্রেসের অধীর চৌধুরী এগিয়ে থাকলেও রাউন্ড যত এগিয়েছে, তত চালিয়ে খেলেছেন তৃণমূলের পাঠান। প্রথম দিকে ৬১৮ ভোটে এগিয়ে থাকলেও নবম রাউন্ড গণনার পর দেখা গেল অধীরের চেয়ে পাঠান এগিয়ে ৩৩,৯৩৪ ভোটে। বেলা গড়াতে দেখা গেল পাঠানের লিড পঞ্চাশ হাজার। শেষ পর্যন্ত পাঠানের কাছে প্রায় ৮৫ হাজার ভোটে পরাজয়ের পর অধীর বলেন, ‘‘বাংলার রাজনীতি ক্রমশ ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। উদার ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি যারা আছে, তাদের জন্য নির্বাচন কঠিন হচ্ছে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘ভোট ঠিকঠাক হয়েছিল। আমাদের চেষ্টার কোনও ত্রুটি ছিল না। পর পর পাঁচ বার জিতেছিলাম। মানুষের দোয়া-আশীর্বাদের ত্রুটি ছিল না। মানুষ মনে করছিল জেতানো দরকার, জিতিয়েছিল। এখন মনে করেছে যে কোনও দরকার নেই , তাই জেতায়নি। কিন্তু নির্বাচন তো নির্বাচন। হেরেছি মানে হেরেছি।’’
২০২২ সালে আসানসোলে উপনির্বাচনে জিতে সাংসদ হন শত্রুঘ্ন। এ বারও তাঁকে প্রার্থী করার কথা আগেই জানিয়েছিল তৃণমূল। আর বিজেপি আসানসোলে ভোজপুরি তারকা পবন সিংহকে প্রার্থী করার কথা জানানোর পরে, পর্দায় তাঁর ভূমিকা ‘বাঙালি বিরোধী’ বলে দাবি করে সরব হয় তৃণমূল। পবন সরে দাঁড়ান। সে কথা মনে করিয়ে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা বিজেপির শুভেন্দু অধিকারী বলেছিলেন, “পবন সিংহকে যখন বিজেপি প্রার্থী করেছিল, ‘বহিরাগত’ বলে তৃণমূল তোলপাড় করেছিল। উনি নিজে প্রার্থিপদ প্রত্যাহার করেছিলেন। কীর্তি আজ়াদ, শত্রুঘ্ন সিন্হা, ইউসুফ পাঠান কোন কালে বাংলার মানুষ ছিলেন, জানতে চাই।” যদিও তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ তার জবাবে বলেছিলেন, “ভৌগোলিক অবস্থানের ভিত্তিতে কাউকে বহিরাগত বলা হয় না। বহিরাগত তাঁরাই, যাঁরা বাংলাকে বঞ্চনা, অপমান করেছেন।”
আসানসোলে শত্রুঘ্নের জয়ের পথে তেমন বাধা দেখা গেল না মঙ্গলবার। যদিও বলিউডের ‘বিহারিবাবু’র বিরুদ্ধে বিজেপি যাঁকে প্রার্থী করেছিল, সেই অহলুওয়ালিয়ার ‘ভোটভাগ্যের’ রেকর্ড ভালই। কিন্তু, ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে আসানসোল লোকসভার সাতটি আসনের মাত্র দু’টি দখলে ছিল বিজেপির। তাই এ বারের লড়াই যে সহজ হবে না, তা বিজেপির কাছে অনুমেয় ছিল। তাই প্রচার হয়েছিল জোরদার। আসানসোলের তীব্র গরমে তৃণমূলের শত্রুঘ্নকে সে ভাবে প্রচারে দেখা যায়নি। তাই বিজেপি ‘বহিরাগত’ কটাক্ষ আরও তীব্র করেছিল। কিন্তু, শেষমেশ রঙিন পর্দার মতো ভোটের ময়দানেও বিপক্ষকে ‘খামোশ’ করলেন শত্রুঘ্ন। জয়ের ছবি যখন পরিষ্কার, তখন সুরেন্দ্রকে গণনাকেন্দ্রে দেখেই তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মী ও সমর্থকেরা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে শুরু করেন। বিকেলেই শত্রুঘ্নকে জয়ী ঘোষণা করে দেয় নির্বাচন কমিশন।
বর্ধমান-দুর্গাপুর কেন্দ্রের সাতটি বিধানসভা এলাকার মধ্যে দু’টি দুর্গাপুর এবং পাঁচটি পূর্ব বর্ধমানের গ্রামীণ এলাকায় পড়ে। প্রাক্তন ক্রিকেটার কীর্তি আজ়াদকে প্রার্থী করার পরে স্থানীয় তৃণমূলের একাংশেরও আশঙ্কা ছিল, তাঁর ভাষার সমস্যা গ্রামীণ এলাকায় জনসংযোগে অন্তরায় হতে পারে। প্রচারে ‘বহিরাগত’ প্রার্থী নিয়ে আক্রমণ সামলানোর বিষয়েও সংশয়ে ছিলেন তাঁরা। বিজেপি তাঁকে প্রার্থী ঘোষণা করতেই দিলীপ ঘোষ তো তাঁকে ‘প্যাক’ করে বিহারে পাঠিয়ে দেওয়ার কথা ঘোষণা করে দেন। কিন্তু ভোটের ফলে দেখা গেল উল্টো ছবি। ’৮৩-র বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য কীর্তির কাছে পরাজয়ের মুখে দিলীপ। তৃণমূল প্রার্থী জিতলেন প্রায় এক লক্ষ ৩৭ হাজার ভোটে।