একই জায়গায় একই সঙ্গে হয়েছে দু’টি নির্বাচন। লোকসভা ও বিধানসভা উপনির্বাচন, দু’টিতেই বরাহনগরে জয়ী হয়েছে জোড়া ফুল। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে দুই প্রার্থীর জয়ের ব্যবধান অনেকটাই। একই রকম ভাবে পয়লা জুন ভোটের পরেও দেখা গিয়েছিল, বরাহনগরে লোকসভা নির্বাচনে যত ভোট পড়েছে, তার থেকে ০.০৫ শতাংশ কম ভোট পড়েছে বিধানসভা উপনির্বাচনে। এমনটা কেন হল? সদুত্তর না মিললেও, বিষয়টি নিয়ে পরবর্তী সময়ে পর্যালোচনার কথা বলছেন স্থানীয় স্তরের তৃণমূল নেতারা।
মঙ্গলবার ভোটের চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পরে দেখা যাচ্ছে, দমদম লোকসভা কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী সৌগত রায় ১২ হাজারের কিছু বেশি ভোটে বরাহনগরে ‘লিড’ (এগিয়ে থাকা) পেয়েছেন। সেখানে ওই দলেরই বিধানসভা উপনির্বাচনের প্রার্থী সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জয়ের ব্যবধান আট হাজারের কিছু বেশি। অর্থাৎ, ব্যবধান প্রায় চার হাজার ভোটের। পরিসংখ্যান বলছে, ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বরাহনগরে তৃণমূল জয়লাভ করেছিল ৩৫ হাজার ভোটে। তার তুলনায় উপনির্বাচনে জয়ের ব্যবধানও বেশ অনেকটা কম। যদিও স্থানীয় নেতৃত্বের দাবি, ‘‘দেশের ভোটের সঙ্গে বিধানসভা উপনির্বাচন হওয়ায়, এমন ফারাক হয়েছে। তবে এই ফারাক যাতে আর না বাড়ে, বরং কমিয়ে আনা যায়, সেটাই লক্ষ্য।’’
বরাহনগরে লোকসভা নির্বাচন ও বিধানসভা উপনির্বাচনের ফলাফল পাশাপাশি রাখলে অনেক কিছুই স্পষ্ট হয়ে যায়। বিধানসভার ক্ষেত্রে, বিজেপি ‘ঘুঁটি’ সাজানোর ফলে জোড়া ফুলের নীচের তলায় ‘চোরকাঁটা’র যে আশঙ্কা করা হয়েছিল, তার খানিকটা ফলাফলে প্রতিফলিত বলেই মত রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের। বরাহনগরে সৌগতের প্রাপ্ত ভোটের থেকে সায়ন্তিকা সামান্য কিছু কম পেয়েছেন। সেখানে বিজেপি লোকসভায় ৫৭ হাজার ৪৫০টি ভোট পেলেও, বিধানসভায় ৩ হাজার ৬৫৩ ভোট বেশি পেয়েছে। আবার বরাহনগরের দু’টি নির্বাচনেই তৃতীয় স্থানে থাকা সিপিএমেরও লোকসভার থেকে বিধানসভায় ২ হাজার ৮৩৭ ভোট কম। অন্য দিকে, ২০২১-এর বিধানসভার নিরিখে পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, তিন বছরের মাথায় উপনির্বাচনে বরাহনগরে বিজেপির ভোট বেড়েছে ১০ হাজার ৬৩৫। সিপিএমের ভোট বেড়েছে ৬ হাজার ৬০০ (২০২১-এ সংযুক্ত মোর্চার কংগ্রেস প্রার্থী পেয়েছিলেন ২০ হাজার ১৩৫ ভোট)। সেখানে তৃণমূলের ভোট কমেছে ১৬ হাজার ৩৬৪।
শেষ তিন বছরে বরাহনগরে বিজেপির সংগঠন তেমন ভাবে মাথাচাড়া দিয়েছে বলে দেখা যায়নি। কিন্তু রাজনৈতিক মহলের একাংশের ধারণা, ভোট ওঠানামার এই খেলায় সদ্য শিবির বদল করা তাপস রায়ের পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে। কারণ, তিনি বরাহনগরের সমস্ত স্তরের নেতা-কর্মী এবং বিভিন্ন ব্যবসায় বিনিয়োগকারীদের ঠিকুজি জানতেন। সেই ‘ব্লু-প্রিন্ট’ হাতিয়ার করে ময়দানে নেমে উপনির্বাচনের পদ্ম প্রার্থী জোড়া ফুলের নিচু স্তরের নেতা-কর্মী ও বিনিয়োগকারীদের একাংশকে গোপনে ‘চাপ’-এ রেখেছিলেন। তাতেই তৈরি হওয়া ‘চোরাস্রোত’-এর কারণে বরাহনগর পুরসভার বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডে তৃণমূল পিছিয়ে গিয়েছে বলে অনুমান। পাশাপাশি, বরাহনগরে লোকসভার ক্ষেত্রে তিন দলের মধ্যে লড়াই হলেও, বিধানসভায় সেটি হয়েছে প্রার্থী বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক।
বরাহনগর বিধানসভার মধ্যে ওই পুরসভার ৩৪টি এবং কামারহাটি পুরসভার আরও ৪টি ওয়ার্ড রয়েছে। প্রাথমিক বিশ্লেষণে জানা যাচ্ছে, এই ৩৮টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৪-১৬টিতে কম-বেশি ভোটে হার হয়েছে তৃণমূলের। আর প্রায় ১০টি ওয়ার্ডে জিতলেও, ব্যবধান রয়েছে একশোর মধ্যে। ১০ থেকে ১২টি ওয়ার্ডে সেই ব্যবধান থেকেছে ১০০ থেকে ৫০০-এর মধ্যে। অবশ্য ৫০০ থেকে ১০০০-এর মধ্যে জয়ের ব্যবধান রয়েছে ২-৩টি ওয়ার্ডে।
বিধানসভা উপনির্বাচনের জয়ী প্রার্থী সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এই নির্বাচনে বিজেপি ছলচাতুরি অনেক করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সে কাজে কতটা তারা সফল হয়েছে, সেটা স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব পর্যালোচনা করলে বোঝা যাবে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘তবে বরাহনগরের প্রত্যেক কর্মী ব্যক্তিগত স্তরে দলকে জেতাতে লড়াই করেছেন। একই সঙ্গে বরাহনগরবাসী আমাকে বিশ্বাস করেছেন, আমার উপরে ভরসা রেখেছেন। আমি তাঁদের সকলের কাছে কৃতজ্ঞ।’’