• এতো বড়ো হারের পর মোদীর উচিত ছিল নিজে সরে যাওয়া, কালীঘাটের বৈঠকের পর সরব মমতা
    দৈনিক স্টেটসম্যান | ০৯ জুন ২০২৪
  • প্রশান্ত দাস: চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় ৪২ এর মধ্যে ২৯টি আসনেই জয়ী হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। নবনির্বাচিত সাংসদ, রাজ্যসভার দলীয় সাংসদ, জেলা সভাপতিদের সঙ্গে কালীঘাটে শনিবারের দুপুরে বৈঠকে বসেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। সংসদে তৃণমূলের দাবি কী থাকবে, নবনির্বাচিত সাংসদদের দায়িত্ব কী হবে, সর্বোপরি দলের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক সক্রিয়তা কিভাবে বজায় রাখা সম্ভব হবে এই বিষয়েই নিজ সহযোদ্ধাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন মুখ্যমন্ত্রী। বৈঠকের শেষে একাধিক নবনির্বাচিত সাংসদদের সঙ্গে নিয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন তৃণমূল নেত্রী। তখনই লোকসভা এবং রাজ্যসভায় দায়িত্বপ্রাপ্ত দলীয় ব্যক্তিবর্গের নাম ঘোষণা করেন মমতা। তিনি বলেন, "লোকসভায় তৃণমূলের দলনেতা থাকছেন সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, মুখ্যসচেতক থাকছেন কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ডেপুটি লিডার কাকলি ঘোষ দস্তিদার, প্যানেল অব চেয়ারম্যান তথা স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যানের নাম পরে জানানো হবে। পাশাপাশি রাজ্যসভায় দলনেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন, উপ দলনেতা হলেন সাগরিকা ঘোষ, চিফ হুইপ হলেন নাদিমুল হক।"

    এদিন দফায় দফায় বিজেপি-র বিরুদ্ধে তোপ দাগেন মমতা। তিনি বলেন, নরেন্দ্র মোদীর উচিৎ ছিল সরে যাওয়া। তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য,"আমাদের সাংসদদের স্পষ্ট করেছি, আমাদের পারফরমেন্স নিয়ে। আমরা বসে থাকার জন্য যাচ্ছি না। ইন্ডিয়া ব্লক সবটা দেখছে। মোদীবাবুকে দেশ চায়না। দেশে পরিবর্তন দরকার। এতো বড়ো হারের পর মোদীবাবুর উচিৎ ছিল এটা অন্য কাউকে ছেড়ে দেওয়া। ধমকে-চমকে, ১৪৭ জনকে তাড়িয়ে দিয়ে, দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেখিয়ে যেকোনও বিল পাস করা যাবে না। এনআরসি নিয়ে আলোচনা চাইবে আমাদের লোকেরা। আর এই এনআরসি বাতিল করতে হবে। এনআরসি, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি যেগুলো গায়ের জোর দেখিয়ে আনা হয়েছিল, সেসব বাতিল করতে হবে। নতুন সরকার আল্টিমেটলি ইন্ডিয়া-রই হবে। যে কটা দিন থাকে একটু সামলাতে দিই। একটু দেখতে দিন নিজেদের কতদূর সন্তুষ্ট রাখতে পারছে।" এরপর মমতার আরও সংযোজন, "ইন্ডিয়া আর এনডিএ এর মধ্যে তফাৎ কি জানেন? এনডিএ-তে যে দলগুলি আছে তাঁদের সবার প্রতি আমার শ্রদ্ধা আছে। তাঁদের সবার চাওয়াটাও বেশি আছে। কিন্তু ইন্ডিয়াতে যাঁরা আছে, অর্থাৎ আমাদের কিছু চাইনা। আমরা শুধু মানুষ এবং দেশের ভালো চাই।"

    মেদিনীপুর পূর্বের ভোট লুঠ হয়েছে, স্পষ্ট দাবি মমতার। তাঁর ভাষায়, "মেদিনীপুর পূর্বে পুরোটাই ভোট লুঠ হয়েছে। ডিএম, আইসি পরিবর্তন করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে ভোট লুঠ চলেছে সেখানে।" এরপরই সরাসরি উল্লেখ না করে বিধানসভা নির্বাচনে শুভেন্দু অধিকারীর জয়ের প্রসঙ্গ টেনে মমতা বলেন,"এক্সিট পোলের ফলাফল দু?দিনের মধ্যেই ঘুরে যায়, লোডশেডিং করে জেতা আসনেও হারিয়ে দেওয়া হয়! আমি দেখছি, এতো কিছু করার পরও কার কি পোর্টফোলিও আসে এবং গ্যারান্টির নামে যে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল, সেটাই বা কতদিন চলে।" নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। তা না হলে তৃণমূল আরও আসনে জয়ী হত। এমনই বলেন মমতা। এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাব তিনি বলেন, "আমরা ২৯টি আসনে নয়, ৩৫টি-তে জিতেছি। ওই আসনগুলিতে বিজেপি এবং নির্বাচন কমিশন কারচুপি করেছে।"

    এদিন তাঁর আলোচনায় উঠে আসে হরিয়ানার প্রসঙ্গ। মুখ্যমন্ত্রীর বার্তা, হরিয়ানার কৃষকদের পাশে আছেন মমতা বন্দোপাধ্যায় এবং তাঁর দল তৃণমূল। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "আমাদের প্রথম কাজ ডেরেক, সাগরিকা ঘোষ, দোলা সেন, নাদিমের একটি দল হরিয়ানার কৃষকদের সঙ্গে দেখা করুক। আমরা তাঁদের পাশে আছি। আমরা সরকারের কাছে দাবি করব, মিনিমাম প্রাইস সাপোর্ট দেওয়া হোক। যাঁর জন্য কৃষকরা লড়ছেন।"

    নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের দিনই শেয়ার বাজারে নামে ধস, আর্থিক ক্ষতি হয় দেশ জুড়ে। এ প্রসঙ্গেও মমতা বিঁধেছেন বিজেপিকে। তিনি বলেন,"দ্রব্যমূল্য বাড়ছে, বেকারত্ব বাড়ছে। শেয়ার কীভাবে এত বেড়ে গেল যে একদিনে এত কিছু হল, এত টাকার মার্কেটিং হল? কে কে যুক্ত? শেয়ার বাজার আমি বুঝি না। তবে কাগজে দেখে বুঝেছি, ডাল মে কুছ কালা হ্যায়! ভোটের দিন, গণনার দিন, গণনার আগের দিন যা যা হয়েছে, টোটাল স্ক্যাম। বড় দুর্নীতি হয়েছে। তদন্ত হওয়া দরকার।"

    এরপরই মমতা বলেন, "দ্বিতীয়ত আমরা নজরে রাখব, যত তাড়াতাড়ি দুর্বল এই সরকার ঘরে ফিরে যায় সেই দিকে। এদের কাছে দেশের জন্য কিছুই নেই। ইলেকশন কমিশনের ম্যানুপুলেশন হয়েছে। অবজার্ভারের ভূমিকা দেখা দরকার। এখানে সিআরপিএফ, এজেন্সি পাঠিয়ে দিয়েছে। একজন এসপি ৪৫ লক্ষ টাকা ধরতেই এসপি বদল! একক সংখ্যাগরিষ্ঠও নয়, ৪০০ পারও করেনি। বিল কীভাবে পাশ করবেন? দুই তৃতীয়াংশ মেজরিটি ছাড়া কীভাবে পাশ করবেন? একনায়কতন্ত্রেরও একটি গন্ডি থাকে। সেটাও ছিল না! আজ গোটা বিশ্বে চর্চা হচ্ছে বিজেপিকে নিয়ে। যিনি তৃতীয়বার শপথ নিতে চলেছেন, সেই দল দেশের লোকতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকারক হবে। যত তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে যায়, ঠিক হবে।"

    এদিন মমতা নবনির্বাচিত সাংসদদের বিজেপি-র ফাঁদে পা না দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, "আমি সমস্ত সাংসদকে বলব, যে দলেরই হোন, নিজের নিজের দলকে শক্তিশালী করুন। এর ওর দল ভাঙার চেষ্টা করবেন না, বিজেপি সেটা চাইবেই। বিজেপিকে বুঝতে হবে এবার। আপনার দলই ভেঙে যাবে। আমরা ভাঙব না। কিছুদিনের মধ্যে নিজেরাই চলে যাবে। অনেকে খুশি নয়, দেখছি তো!"

    উল্লেখ্য, লোকসভা এবং রাজ্যসভা মিলিয়ে তৃণমূলের প্রতিনিধির সংখ্যা ৪২। তৃণমূলই তৃতীয় বৃহত্তম দল সংসদে, সেটিও জানিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী। তৃণমূলের মহিলা সাংসদের প্রসঙ্গে বলেন, "সমগ্র পৃথিবীরটা জানিনা। তবে ভারতবর্ষে তৃণমূলের মহিলা সাংসদের পরিসংখ্যানটা হলো ৩৮%।" বিধানসভায় এগিয়ে থাকা আসনের হিসেব দিয়ে মমতা বলেন, "লোকসভা এবং বিধানসভা ভোটে তফাৎ আছে। তবু হিসাবের জন্য বলি, ২০১৯ এর ভোটে বিধানসভাওয়াড়ি হিসাবে ১৬১ সিটে এগিয়ে ছিলাম। বিজেপি ১২১টা সিটে এগিয়েছিল। এবার আমরা ১৯২টা সিটে এগিয়ে আছি। বিজেপি মাত্র ৯০ টায় এগিয়ে। অনেক জায়গায় মিথ্যা কথা বলছে বা খাওয়াচ্ছে। এখনও লজ্জা হয়নি।"

    এদিন বিরোধী জোট ইন্ডিয়া-র সকল নেতৃত্বদের কলকাতায় আসার জন্য অগ্রিম স্বাগত জানিয়েছেন মমতা। পাশাপাশি বলেন, "মানুষকে ধন্যবাদ জানাব, ওদের (বিজেপি) ভোট না দেওয়ায় জন্য। আমরা ২১ জুলাই জনগণকে ধন্যবাদ জানাব।" এদিন সাংবাদিক সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রীর সাথে উপস্থিত ছিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ অভিষেক বন্দোপাধ্যায়, ঘাটালের সাংসদ দীপক অধিকারী ওরফে দেব, বহরমপুরের সাংসদ ইউসুফ পাঠান, বর্ধমান-দুর্গাপুরের সাংসদ কীর্তি আজাদ, আসানসোলের সাংসদ শত্রুঘ্ন সিন্‌হা, কলকাতা উত্তরের সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় সহ প্রমুখ।
  • Link to this news (দৈনিক স্টেটসম্যান)