• ভারতের নির্বাচন পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্য ইতিবাচক জায়গা তৈরি করেছে
    দৈনিক স্টেটসম্যান | ১১ জুন ২০২৪
  • বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমের প্রতিক্রিয়া
    বাসুদেব ধর
    ‘ভারতে গণতন্ত্রের চর্চা বলিষ্ঠ হলে তা দক্ষিণ এশিয়ার গণতন্ত্রকামী মানুষের জন্য প্রেরণাদায়ক শক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়৷ ?অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচন ভারতের ও পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্য ইতিবাচক জায়গা তৈরির সুযোগ করে দিয়েছে৷’
    ‘ভারত ধারাবাহিকভাবে গণতন্ত্রের চর্চা করছে৷ এর বিপরীতে যখন যে শক্তি এসেছে, তাকে সুযোগমতো বার্তা দিয়েছে৷ এবারও তারা সে বার্তা দিল ইভিএমে বোতাম টিপে৷ ’
    ভারতে অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশে সংবাদ মাধ্যমে এভাবেই চর্চা হচ্ছে৷ এক ইংরেজি দৈনিক সংবাদ ভাষ্যের শিরোনাম দিয়েছে ‘পরাজয়ের অনুভূতিসম্পন্ন একটি জয়’৷ আর কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটের নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, ‘বিজয়ের সাদৃশ্য একটি পরাজয়৷ ’ লোকসভা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা থেকে সাত সফায় ভোট গ্রহণ এবং ৪ জুন ফলাফল ঘোষণার দিকে বাংলাদেশের চোখ ছিল, সংবাদ মাধ্যম খবর ছেপেছে, মন্তব্য প্রকাশ করেছে নিয়মিত৷ ৪ জুন সকাল থেকে অনলাইন সংবাদ মাধ্যম ও টেলিভিশন প্রতি মুহূর্তের ফল জানিয়েছে৷ বিশ্লেষকরা আলোচনা করেছেন৷
    প্রায় প্রতিটি সংবাদ বিশ্লেষণে অবশ্য বলা হয়েছে, ভারতে নির্বচনে যে দল বা জোটই ক্ষমতায় আসুক বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে অবশ্য কোনো তারতম্য হবে না৷ কংগ্রেস সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে শেখ হাসিনার পাশে থেকেছে, নির্বাচনে প্রকাশ্যে সমর্থন ঘোষণা করেছে৷ নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পরও এই সমর্থন শুধু অব্যাহতই থাকেনি, বরং নতুন মাত্রা পায়৷ ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ থেকে সবার আগে শুভেচ্ছা জানিয়েছিল বিএনপি এই আশায় যে, কংগ্রেসের সঙ্গে যেহেতু আওয়ামি লিগের সম্পর্ক সেই ১৯৭১ সাল থেকে এবং মোদি কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সোচ্চার, তাই স্বাভাবিকভাবে বিজেপির সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হবে৷ রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে সহায়তা পাওয়া যাবে৷ কিন্ত্ত সে আশায় গুড়ে বালি, মোদির সঙ্গে শেখ হাসিনার সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছায়৷ এখানে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ প্রাধান্য পেয়েছে, বিএনপির হিসেব মেলেনি৷ এর পর থেকে বিএনপি আরও ভারতবিরোধী৷
    কিন্ত্ত এবারে দেখা গেল, ভারতে নির্বাচনের প্রশংসা করেছে ভারতবিরোধী দলগুলোও৷ এটার পেছনে অবশ্য রাজনীতি আছে৷ সংবাদ মাধ্যমে কলামিস্টরাও বলেছেন, গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা ভোটারদের পরিপক্ক করেছে৷ উদার গণতন্ত্রের স্বাদ পাওয়া ভারতের ভোটাররা সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে কখনো ভুল করেননি৷ গণতন্ত্রের চর্চা যেখানে আছে সেখানে এমনটি দেখা যায়৷
    দৈনিক প্রথম আলো ‘ভারতে নির্বাচনের ফলাফল, গণতন্ত্রে জনগণই নিয়ামক শক্তি’ শিরোনামে সম্পাদকীয়তে লিখেছে, ‘ ভারতের সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচন আবারও প্রমাণ করল যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণই নিয়ামক শক্তি৷ তীব্র বৈরী রাজনৈতিক পরিবেশের মধ্যেও যে সব দল ও পক্ষ মিলে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন করা সম্ভব, ভারতের ৬৪ কোটি ভোটার তা প্রমাণ করেছেন৷ আমরা ভারতের গণতন্ত্রকামী জনগণ ও রাজনৈতিক নেতৃত্বকে অভিনন্দন জানাই৷ ’
    ‘এই নির্বাচনের ফলাফল যে সত্যকে প্রকাশ করেছে, তা হচ্ছে বিজেপির ভেদনীতি ও হিন্দুত্ববাদ ভোটারদের কাছে আগের চেয়ে গুরুত্ব হারিয়েছে৷ শুধু এর ওপর ভিত্তি করে জনগণের আস্থা ও সমর্থন ধরে রাখা যায় না৷ দেশ পরিচালনায় সরকার কতটা দক্ষ, আর্থসামাজিক নীতিগুলো কতটা জনমুখী, জনগণ তার সুফল পাচ্ছে কি না, সমাজে বৈষম্য বাড়ছে কি না-এসব বিবেচনা ভোটারদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ ’
    ‘এবারের নির্বাচনে ভারতের বিরোধী দলগুলো একজোট হয়ে তাদের নির্বাচনী প্রচারে আর্থসামাজিক উন্নয়নে সরকারের ব্যর্থতা, জনজীবনের নানা সমস্যা, দুর্নীতি ও বৈষম্যের দিকগুলোকেই তুলে ধরেছে৷ ‘ইন্ডিয়া’ জোটের ভালো ফল করার পেছনে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর ভারত জোড়ো যাত্রা যেমন ভূমিকা রেখেছে, তেমনি গত ১০ বছরে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে মোদি সরকারের বিভিন্ন ভুল নীতিও ভূমিকা রেখেছে৷ এবারের নির্বাচনের ফলাফল তাই দুই পক্ষের জন্যই শিক্ষণীয় অনেক কিছু তুলে ধরেছে৷ ’
    ‘গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা গেলে ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়া যায় এবং তা সংশোধনের সুযোগ তৈরি হয়৷ এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য৷ ভারতের এবারের নির্বাচনের ফলাফল সেই বার্তাই দিয়েছে৷ ’
    ‘ভারতের এই নির্বাচন বাংলাদেশের জন্যও একটি বড় শিক্ষণীয় বিষয় হতে পারে৷ ৭৭ বছর বয়সী স্বাধীন ভারতে এক দিনের জন্যও গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা ব্যাহত হয়নি৷ কিন্ত্ত বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণে সেটি ব্যাহত হয়েছে৷ বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক বিষয়ে বড় পার্থক্য নেই৷ রাজনৈতিক বিষয়ে পার্থক্যটিও ভারতের মতো প্রকট নয়৷ এরপরও অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন থেকে এখন অনেক দূরে সরে গেছে বাংলাদেশ৷ ’
    ‘দুই প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সুসম্পর্ক আছে৷ ব্যবসা-বাণিজ্য ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিপুল অগ্রগতি হয়েছে৷ কিন্ত্ত এরপরও তিস্তার পানিবণ্টনসহ অনেক বিষয় অমীমাংসিত থেকে গেছে৷ ভারতের নতুন সরকারের অভিষেক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি যাচ্ছেন৷ আমরা আশা করতে পারি, ভারতের নতুন সরকার অমীমাংসিত সমস্যাগুলো সমাধানে কার্যকর ও ফলপ্রসূ পদক্ষেপ নেবে৷ ’
    সাবেক কূটনীতিক এম হুমায়ুন কবীর ‘ভারতে গণতন্ত্রের চর্চা দক্ষিণ এশিয়ার জন্য প্রেরণার’ শিরোনামে এক বিশ্লেষণে লিখেছেন, ‘আসলে এবারের নির্বাচনে জিতেছে ভারতের জনগণ, যা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ এবারের নির্বাচনের প্রেক্ষাপটের দিকে তাকালে বেশ কিছু দিক সামনে আসে৷ নির্বাচনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল রাজনৈতিক দলগুলো৷ নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা, সক্ষমতা ও কার্যকারিতা নিয়ে অভিযোগ উঠেছিল৷ ? কিন্ত্ত ভারতের জনগণ শেষ পর্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছে৷ ’
    সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার এক বিশ্লেষণে লিখেছেন, ‘১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকে ভারত ধারাবাহিকভাবে গণতন্ত্রের চর্চা করে আসছে৷ ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা জারি এর ছন্দপতন ঘটায়৷ তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে সবল নেতৃত্ব ও কুশলী রাজনীতিক ভারতরতœ ইন্দিরা গান্ধী৷ এতো সব সত্ত্বেও জরুরি অবস্থা জারি ও প্রাসঙ্গিক কিছু কালাকানুন ভারতের জনগণ মেনে নেয়নি৷ ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে তিনি ও তাঁর দল পরাজিত হন৷ ভারতীয় জনগণ সফল হয় কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটাতে৷ ’
    ‘তবে ১৯৮০ সালে সেই ইন্দিরা গান্ধী আবার বিরাজমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এবং তাঁর আগের সরকারের সময়ের বাড়াবাড়ির জন্য ভারতীয় ভোটারদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলে আবারও বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে তিনি গঠন করেন সরকার৷ আমৃতু্য বহাল ছিলেন প্রধানমন্ত্রী পদে৷ সে দুটি নির্বাচন ভারতের ভোটারদের গণতন্ত্র ও সুশাসনের প্রতি অঙ্গীকারের প্রতিফলন বলে বিবেচনা করা হয়৷ ’
    ‘এবারের নির্বাচনের আগে টানা ১০ বছর ক্ষমতায় ছিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি সরকার৷ এর আগে মোদি ছিলেন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী৷ সেখানকার একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় তিনি বিতর্কিত হলেও অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে দক্ষতার ছাপ রাখেন৷ ভারতবাসী ২০১৪ সালে তাঁর মধ্যে একজন যোগ্য ও দক্ষ নেতার ছাপ দেখতে পেয়ে নির্বাচিত করেন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে৷ এর পরবর্তী ২০১৯ সালের নির্বাচনেও তিনি সে বিজয়ের ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন৷ এই ১০ বছর শাসনকালে তিনি ভারতের সামষ্টিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন৷ বৃদ্ধি পেয়েছে জিডিপি ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ৷ সবল করেছেন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা৷’
    ‘তবে অভিযোগ রয়েছে মুদ্রাস্ফীতি, আয়বৈষম্য ও ধনিকশ্রেণির সপক্ষে বিভিন্ন আইন প্রণয়নের৷ আরও অভিযোগ আছেÑধর্মীয় সংখ্যালঘুসহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বিরাজমান দ্বন্দ্ব দমনে ব্যর্থতা৷ দরিদ্র ও সমাজের অবহেলিত অংশের প্রতি রাজ্য সরকারগুলোর বিভিন্ন কল্যাণকর কর্মসূচিতে যথাযথ সহযোগিতা না করার অভিযোগও বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে রয়েছে৷ সম্ভবত নির্বাচনী ফলাফলে ঘটেছে এর প্রতিফলন৷ ’
    ভারতের নির্বাচন বিশ্লেষণ করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় ইউনিভার্সিটির ডিস্টিংগুইশড অধ্যাপক আলী রীয়াজ লিখেছেন, ভারতে নির্বাচনের ফল বৈশ্বিকভাবে গণতন্ত্রকামীদের সামান্য নিশ্বাস ফেলার সুযোগ তৈরি করেছে৷ কিন্ত্ত অবস্থার বদল ঘটবে কি না, তা নির্ভর করে ভারতের নাগরিক সমাজ ও বিরোধী রাজনীতিবিদেরা তাদের প্রতিরোধ অব্যাহত রাখছেন কি না, তার ওপর৷
    এখনো ভারতের নির্বাচন নিয়ে নানা চর্চা অব্যাহত রয়েছে বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমে, টেলিভিশনে আলোচনায়৷ মোদির সরকার গঠন, জোট সরকার, শপথ গ্রহণের খবরও নানা বিশ্লেষণসহ প্রকাশ করা হচ্ছে৷ মূলত টানা তৃতীয় মেয়াদে নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে প্রধান শিরোনামে৷ আরও বলা হয়েছে, শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের সভাপতি মল্লিকার্জুন খাগড়ে উপস্থিত থাকলেও পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেস বর্জন করে৷
  • Link to this news (দৈনিক স্টেটসম্যান)