বারাসত লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত হাবড়া এবং অশোকনগর বিধানসভা কেন্দ্রে এ বারও ভরাডুবি হল বামেদের। লোকসভা ভোটের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, বাম প্রার্থী সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় হাবড়া বিধানসভা থেকে পেয়েছেন ৯ হাজার ৩১৪ ভোট। অশোকনগর থেকে পেয়েছেন ১১ হাজার ৩২২ ভোট।
বারাসত কেন্দ্রে ২০১৯ সালে বামেরা সামান্য ভাল ফল করেছিল। সে বার হাবড়া থেকে বাম প্রার্থী হরিপদ বিশ্বাস পেয়েছিলেন ১০ হাজার ১৫৫ ভোট। অশোকনগর থেকে পেয়েছিলেন ১৯ হাজার ৪২৩ ভোট। এ বার সঞ্জীব বারাসত লোকসভার মধ্যে সব থেকে বেশি ভোট পেয়েছেন বারাসত বিধানসভা এলাকা থেকে। প্রাপ্ত ভোট, ২১ হাজার ৯০০।
উত্তর ২৪ পরগনা জেলায় বাম আমলে হাবড়া, অশোকনগর ছিল সিপিএমের শক্ত দুর্গ। সেই দুর্গে প্রথম আঘাত লাগে ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটে। রাজ্যে রাজনৈতিক পালা বদলের পর থেকে এখানে সিপিএমের রক্তক্ষরণ শুরু হয়। যা এখনও অব্যাহত। ২০১১ সালের পরে বামেরা এখানে সাংগঠনিক ভাবে দুর্বল হতে থাকে। অনেক নেতা-কর্মী প্রথমে তৃণমূলে, পরে বিজেপিতে চলে যান। সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলিতে সিপিএম বা বামেদের সরিয়ে হাবড়া-অশোকনগরে বিজেপি বিরোধী দল হিসেবে উঠে এসেছে।
সিপিএম সাংগঠনিক ভাবে দুর্বল হলেও হাবড়া-অশোকনগর এলাকায় দলের মিটিং-মিছিল, জনসভায় ভিড় উপচে পড়েছে সাম্প্রতিক কালে। এ বারের ভোটের তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু সেই ভিড়ের প্রতিফলন পড়েনি ইভিএমে। বাম নেতৃত্ব এ বার হাবড়া-অশোকনগর থেকে ভাল ফলের আশা করেছিলেন। তার কারণ, করোনা, লকডাউন পরিস্থিতিতে এবং আমপানের পরে বাম কর্মীরা মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে নানা কাজ করা প্রশংসিত হয়েছিলেন। অক্সিজেন সিলিন্ডার, ওষুধ, খাদ্যসামগ্রী বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া, করোনা আক্রান্ত রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি করা, ত্রাণ শিবির খুলে মানুষকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেছিলেন বাম কর্মীরা। এ সব কাজের মাধ্যমে জনসংযোগের কাজ হয়েছিল বলে দাবি করেন নেতারা। এ বার ভোটের আগে নিষ্ক্রিয় কর্মীরাও অনেকে সক্রিয় হয়েছিলেন বলে নেতৃত্ব দাবি করেছিলেন। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের ভিড় দেখা যাচ্ছিল কর্মসূচিতে। কিন্তু ভোটে তার বিশেষ প্রতিফলন ঘটেনি বলেই দেখা যাচ্ছে।
হাবড়ায় গত পুরভোটে বামেরা প্রায় ২০ হাজার ভোট পেয়েছিল। এ বার ভরাডুবির কারণ কী?
হাবড়ার সিপিএম নেতা আশুতোষ রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘লোকসভা ভোটের আঙ্গিক আলাদা। কেন্দ্রে বামেদের উপস্থিতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয়। সার্বিক ভাবে এটা আমরা মানুষকে বোঝাতে পারিনি বা মানুষ বুঝতে পারেননি। সে কারণেই হাবড়ায় আমাদের ফল ভাল হয়নি।’’ অশোকনগরে বামেদের ফল নিয়ে সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সত্যসেবী কর বলেন, ‘‘এখানে ভোট ধর্মীয় এবং সাম্প্রদায়িক ভাবে বিভক্ত করে দেওয়া হয়েছিল।’’
বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রে বামেরা এ বার প্রার্থী দেয়নি। কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতা হয়। কংগ্রেস প্রার্থী এ বার ভোট পেয়েছেন ৬৫ হাজার ১৭৬। গত লোকসভা ভোটে কংগ্রেস, সিপিএম আলাদা প্রার্থী দিয়েছিল। সিপিএম প্রার্থী একাই পেয়েছিলেন ৯০ হাজার ১২২ ভোট।
এক সময়ে বামফ্রন্টের দুর্গ বলে পরিচিত বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্রে সিপিএম প্রার্থী নিরাপদ সর্দার চতুর্থ স্থান পেয়েছেন। জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে তাদের।
বসিরহাট থেকে এক সময়ে ভোটে জিতে ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত পার্লামেন্টের ডেপুটি স্পিকার হয়েছিলেন। ২০০৯ সালে সিপিআই প্রার্থী অজয় চক্রবর্তীকে হারিয়ে তৃণমূলের নুরুল ইসলাম সাংসদ হন। এরপর থেকে কখনও বামফ্রন্ট, কখনও বাম-কংগ্রেস জোট বসিরহাট কেন্দ্রে লড়েছে। তবে জিততে পারেনি কোনও বারই।
২০১৪ সালে বাম-কংগ্রেস জোট লড়াই করে পরাজিত হন সিপিআই প্রার্থী নুরুল হুদা। ২০১৯ সালে জোট ভেঙে গিয়ে কংগ্রেস এবং বামফ্রন্ট আলাদা লড়াই করেছিল। সে বার দু’দলেরই জমানত বাজেয়াপ্ত হয়।
বাম-কংগ্রেস জোটের সিপিএম প্রার্থী নিরাপদ সর্দার এ বার ৭৭,৮৯৯টি ভোট পেয়েছেন। আইএসএফের ভোটও তাদের থেকে বেশি। যদিও জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে তাদেরও।
নিরাপদের যুক্তি, ‘‘সাধ্য মতো লড়াই করলে কী হবে, শাসক দলের ছাপ্পার কাছে পরাজিত হতে হয়েছে।’’ কংগ্রেস নেতা হিরন্ময় দাসের কথায়, ‘‘আমরা সাধ্য মতো লড়াই করেছি। প্রশাসন অভিযোগগুলি খতিয়ে দেখলে আমাদের ভোট আরও বাড়ত।’’
তবে বসিরহাটের তৃণমূল নেতা সপ্তর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘দিদির উন্নয়নমূলক প্রকল্প দেখে মানুষ ভোট দিয়েছেন। ছাপ্পার প্রশ্ন ওঠে না।’’
জেলায় সিপিএম তথা বামেদের খারাপ ফল প্রসঙ্গে জেলা সিপিএম সম্পাদক মৃণাল চক্রবর্তী বলেন, ‘‘এ বার বিজেপি বিরোধী ভোট হয়েছে। মানুষ মনে করেছেন, সিপিএমের থেকে তৃণমূল বিজেপিকে হারাতে পারবে। তাই তৃণমূলকে ভোট দিয়েছেন। তবে বামেদের কেন এমন ফল হল, তার পর্যালোচনা না করে মন্তব্য করা যাবে না।’’