আশা ছিল, অন্তত এ বার লোকসভা ভোটে হাল ফিরবে। হাল তো ফেরেইনি, বরং ‘পুরনো দুর্গ’ পূর্ব মেদিনীপুরে ক্রমশই বেহাল হচ্ছে সিপিএম। শোচনীয় পরিস্থিতি বামেদের জোট সঙ্গী কংগ্রেসেরও।
প্রতিবারের মতো এ বারেও লোকসভা ভোটের ফলাফল নিয়ে শুরু হয়েছে কাটা-ছেঁড়া। আর তাতেই দেখা যাচ্ছে, ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতিতে নন্দীগ্রামের জেলায় ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে বাম-কংগ্রেস জোট। গোটা রাজ্যের সঙ্গে পূর্ব মেদিনীপুরেও এ বার বামেদের ভোট প্রাপ্তি গতবারের তুলনায় অনেক কমেছে। পূর্ব মেদিনীপুরের দু’টি লোকসভা আসন— কাঁথি আর তমলুক। দুই আসনেই বামেদের ভোট পাঁচ শতাংশের নীচে।
কাঁথি লোকসভা কেন্দ্রের কংগ্রেস প্রার্থী ঊর্বশী বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘আমাদের দলের কর্মীদের সঙ্গে বামেরা খেটে প্রচার করেছেন। যদিও এ বার পুরোপুরি বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট হয়েছিল। কিছু কিছু জায়গায় যেখানে আমরা একটিও ভোট পেতাম না, এ বার সেখানেও প্রতি বুথে পাঁচ থেকে ছ’টি করে ভোট পেয়েছি।’’ সিপিএমের পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য হিমাংশু দাস বলছেন, ‘‘সংবাদমাধ্যম যে ভাবে তৃণমূল আর বিজেপিকে প্রতিটি ঘটনায় মূল প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখিয়েছে, তাতে মেরুকরণের রাজনীতি করতে তাদের আরও সুবিধা হয়েছে।’’
বাম-নেতাদের পর্যবেক্ষণ, কাঁথি লোকসভা কেন্দ্রে ঊর্বশী বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রার্থী হিসেবে অনেক দেরিতে নাম ঘোষণা করেছে কংগ্রেস। ততদিনে তৃণমূল আর বিজেপি, এমনকি এসইউসির মতো দলও অনেকটাই প্রচারে এগিয়ে গিয়েছিল। সংখ্যালঘু সমর্থক ভোটাররা বিজেপিকে ঠেকাতে তৃণমূলের দিকে ঝুঁকেছেন। আর হিন্দু ভোটাররা অনেকেই বিজেপিতে ছিলেন। এ বার কাঁথি লোকসভায় বিজেপি প্রার্থী সৌমেন্দু অধিকারী পেয়েছেন সাত লক্ষ ৬৩ হাজার ১৯৫ টি ভোট। তৃণমূলের প্রার্থী উত্তম বারিক পেয়েছেন সাত লক্ষ ১৫ হাজার ৪৩১টি ভোট। সেখানে কংগ্রেস প্রার্থী ঊর্বশী বন্দ্যোপাধ্যায় পেয়েছেন মাত্র ৩১১২২টি ভোট। যা মোট ভোটের মাত্র দু’শতাংশ।
২০১৯ সালে কাঁথি লোকসভা কেন্দ্র থেকে সিপিএমের প্রার্থী পরিতোষ পট্টনায়ক একা পেয়েছিলেন ৭৬,১৮৫টি আর কংগ্রেসের দীপক দাস পেয়েছিলেন ১৬,৮৫১টি ভোট। অর্থাৎ গতবারে বাম এবং কংগ্রেস প্রার্থীর মোট ভোটের এক-তৃতীয়াংশ ভোট এ বার পেয়েছেন ঊর্বশী। একই রকম ভাবে, গত লোকসভা নির্বাচনে তমলুক লোকসভা কেন্দ্রে কংগ্রেস প্রার্থী লক্ষ্মণ শেঠ পেয়েছিলেন ১৬,০০১টি এবং সিপিএমের শেখ ইব্রাহিম আলি পেয়েছিলেন এক লক্ষ ৩৬,১২৯টি ভোট। সেখানে এ বার সিপিএম প্রার্থী সায়ন বন্দ্যোপাধ্যায় পেয়েছেন ৮৫,৩৮৯টি ভোট। প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি কমে গিয়েছে সিপিএমের ভোট। শুধু তাই নয় ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে দু’টো লোকসভা কেন্দ্রের ১৪টি বিধানসভার মধ্যে ১১টিতে বামেরা এবং দু’টিতে কংগ্রেস আর মহিষাদলে নির্দলকে সমর্থন করেছিল বামেরা। সেখানেও পাঁশকুড়া পূর্ব বিধানসভাতে সবচেয়ে বেশি ২০,৭১৭টি ভোট পেয়েছিল বামেরা। সেখানে এ বার সিপিএম পেয়েছে ১৩,০৫০ টি ভোট। হলদিয়া শিল্পাঞ্চল এলাকায় ২২ হাজার ৬৮৮ ভোট পেয়েছিল বামেরা। এ বার তারা পেয়েছে ১৭,৮৪৬ টি ভোট। চণ্ডীপুরে বিধানসভা ভোটে ৯৮৩৭টি ভোট পেয়েছিল। এ বার সেখানে ৬১৩৬টি ভোট পেয়েছেন কংগ্রেস প্রার্থী। নন্দীগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে সিপিএম প্রার্থী মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায় পেয়েছিলেন ৬২৬৭ ভোট। এ বার সায়ন পেয়েছেন ৭৫৭৪টি ভোট।
বাম আমলে পূর্ব মেদিনীপুর ছিল ‘লাল দুর্গ’। তবে ২০০৭ সালে নন্দীগ্রামে জমি আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে লোকসভা ভোটে আর জিততে পারেনি বামেরা। যদিও ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে পাঁশকুড়া পূর্ব এবং হলদিয়া আসনে জয় পেয়েছিল তারা। সিপিএমের পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য হিমাংশু দাস বলছেন, ‘‘আগামী ১১ জুন জেলা সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্যদের নিয়ে মিটিং ডাকা হয়েছে।’’ তবে তৃণমূলের জেলা সভাপতি (কাঁথি) পীযূষকান্তি পণ্ডা বলছেন, ‘‘যে সব বাম কর্মী দীর্ঘদিন ধরে জেলায় অধিকারীদের হাতে অত্যাচারিত হয়েছেন, তাঁরা রাজনীতির অঙ্ক বুঝতে পেরে অনেক জায়গাতে তৃণমূলকে সমর্থন করেছেন।’’ আর বিজেপির কাঁথি সাংগঠনিক জেলার অন্যতম সাধারণ সম্পাদক চন্দ্রশেখর মণ্ডল বলছেন, ‘‘বামেরা এখন অপ্রাসঙ্গিক!’’