পোড়খাওয়া নেতারাই শুধু নন, সামগ্রিক ফলাফলের নিরিখে বোলপুর লোকসভা কেন্দ্রের দলীয় প্রার্থীর জয় দুরাশা বলেই ধরে নিয়েছিলেন বিজেপি-র সাধারণ কর্মী-সমর্থকেরা। তা বলে ময়ূরেশ্বর বিধানসভা এলাকাতেও যে দলীয় প্রার্থী পিছিয়ে পড়বেন, তা অনেকেই ভাবতে পারেননি। কারণ, ওই কেন্দ্রটি বিজেপির ‘গড়’ হিসাবে পরিচিত। সেই ‘গড়’ এ বারে হাতছাড়া হওয়ায় মুষড়ে পড়েছেন স্থানীয় বিজেপি কর্মীদের বড় অংশ। এমন ফলের জন্য নেতৃত্বের দিকে আঙুল তুলেছেন দুধকুমার মণ্ডলের মতো পরিচিত মুখ।
প্রসঙ্গত, ময়ূরেশ্বরকে কেন্দ্র করেই বীরভূমে বিজেপির উত্থান বলে মনে করা হয়ে থাকে। বাম আমলে তৃণমূলের সঙ্গে জোটে ময়ূরেশ্বরের দু’টি পঞ্চায়েত সমিতি এবং কয়েকটি পঞ্চায়েত তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ময়ূরেশ্বর এলাকা থেকেই দুধকুমার মণ্ডল, অর্জুন সাহা, শ্যামাপদ মণ্ডল-সহ একাধিক নেতা জেলা সভাপতি হওয়ার পাশাপাশি রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ পদ সামলেছেন। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ময়ূরেশ্বর বিধানসভা আসনে বিজেপি ১,৭৫৯ ভোটে এগিয়ে ছিল। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে অবশ্য তৃণমূল ১২ হাজার ৭৫ ভোটে ওই কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়। পঞ্চায়েত নির্বাচনে শাসকদলকে সমানে টক্কর দিয়ে মল্লারপুর ১ গ্রাম পঞ্চায়েতটি ছিনিয়ে নেয় বিজেপি। ময়ূরেশ্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের ২০টি আসনের মধ্যে ১০টি দখল করে তারা।
সেই অঙ্কে এ বার বিধানসভা ভিত্তিক ফলাফলের নিরিখে ময়ূরেশ্বরের গড় ফিরে পাওয়ার আশায় বুক বেঁধেছিলেন এলাকার বিজেপি কর্মী-সমর্থকরা। কিন্তু হয়েছে উল্টো। ২০ হাজার ৭৫২ ভোটে তৃণমূল এগিয়ে রয়েছে। তুলনামূলক বিচারে ময়ূরেশ্বরে বিজেপির ভাল সংগঠন থাকতেও কেন এত ব্যবধান?
দলের অন্দরে উঠে এসেছে নানা জল্পনা। ময়ূরেশ্বর ১ ও ২ ব্লক নেতৃত্ব-সহ রাজ্য সহ-সভাপতি শ্যামাপদ মণ্ডলের সঙ্গে বিদ্রোহী নেতা দুধকুমারের ‘বিরোধ’ দলে সুবিদিত। সেই বিরোধের জেরে কোনও পক্ষকেই সর্বাত্মক ভাবে প্রচারে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা যায়নি বলে অভিযোগ। প্রার্থী নিয়ে অসন্তোষও কাজ করেছে। বিজেপি সূত্রের খবর, দলের অনেকে প্রার্থিপদের দাবিদার ছিলেন। তাঁরা বীরভূম কেন্দ্রের অন্তর্গত সাঁইথিয়ার বাসিন্দা পিয়া সাহাকে হঠাৎ বোলপুরে প্রার্থী করাটা মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। তাঁদেরও নির্বাচনে তেমন একটা সক্রিয় হতে দেখা যায়নি বলে কর্মীদের পর্যবেক্ষণ। পিয়া সাহা বলেন, ‘‘বিষয়টি দল পর্যালোচনা করে দেখছে।’’ শ্যামাপদ বলেন, ‘‘আমি অন্য জেলার দায়িত্বে ছিলাম। তাই ময়ূরেশ্বরে তেমন সময় দিতে পারিনি। প্রচারের দিক থেকে ময়ূরেশ্বরের অবহেলিত ছিল। অন্য নেতাদেরও তেমন একটা দেখা যায়নি।’’
দুধকুমার মণ্ডল সরাসরি অভিযোগ তুলেছেন, ‘‘দলের নেতাদের একাংশ ভোট করার চেয়ে ভোটের টাকা ভাগাভাগিতে ব্যস্ত থাকলে এমন হাল তো হবেই!’’ তাঁর দাবি, তাঁকে প্রার্থী বা দল প্রচারের জন্য কিছু বলেনি। তবুও দলের একনিষ্ঠ কর্মী হিসাবে নিজের গ্রামে প্রচার করেছেন। বিজেপির সাংগঠনিক জেলা সভাপতি (বোলপুর) সন্ন্যাসীচরণ মণ্ডল এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘দুধকুমারদার মতো এক জন প্রবীণ নেতার কাছে এমন মন্তব্য অবাঞ্ছিত। আমরা সব দিক পর্যালোচনা করে দেখছি।’’
তবে, ব্যবধান বাড়িয়ে জিতেও তৃণমূল খুব স্বস্তিতে নেই। ময়ূরেশ্বর বিধানসভা মধ্যে রয়েছে ময়ূরেশ্বর ১ ব্লকের ৯টি এবং ২ ব্লকের ৭টি পঞ্চায়েত। লোকসভা নির্বাচনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৩টি গ্রাম পঞ্চায়েতে শাসকদলকে পিছনে ফেলে দিয়েছে বিজেপি। তার মধ্যে মল্লারপুর ১ এবং ষাটপলশা পঞ্চায়েত উল্লেখযোগ্য। ১৯৮৩ থেকে কংগ্রেস এবং তৃণমূলের দখলে থাকা পঞ্চায়েতটি ২০১৮ সালে বিজেপি দখল করে। গত নির্বাচনেও পঞ্চায়েতের ১৬ টি আসনের মধ্যে ৯ টি বিজেপি এবং ৭ টি তৃণমূল দখল করে। পঞ্চায়েত সমিতির ৩টি আসনও বিজেপি পায়। এ বারের লোকসভা নির্বাচনে ১৬ টি আসনে প্রায় ৩২০০ ভোটে এগিয়ে আছে তারা।
মল্লারপুর ১ পঞ্চায়েত এলাকার বাসিন্দা এবং দীর্ঘদিনের প্রাক্তন পঞ্চায়েত প্রধান ও পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি ধীরেন্দ্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘বিজেপি হিন্দুত্ববাদী তাস খেলে প্রভাব বিস্তার করেছে। আমরা মানুষকে বুঝিয়ে ধর্মীয় ভাবাবেগ থেকে বের করে আনতে ব্যর্থ হয়েছি।’’ অন্য দিকে, ষাটপলশায় তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের তত্ত্ব সামনে এসে পড়েছে। ওই পঞ্চায়েত এলাকারই বাসিন্দা জেলা পরিষদের প্রাক্তন কর্মাধ্যক্ষ তথা পঞ্চায়েত সমিতির সহসভাপতি জটিল মণ্ডল। এ বার লোকসভায় ১৪টি আসনেই এগিয়ে বিজেপি। যদিও ব্যবধান মাত্র ৬১২। জটিলের বক্তব্য, ‘‘বিজেপি ৪-৫টি বুথে এজেন্ট দিতেই পারেনি। তা সত্ত্বেও তাদের এগিয়ে থাকার কারণ দলের একাংশের অন্তর্ঘাত ছাড়া কিছু হতে পারেনা। আমরা তাদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি।’’ তৃণমূলের দখলে থাকা কুণ্ডলা পঞ্চায়েতেও এ বার এগিয়ে রয়েছে বিজেপি।
তবে, কলেশ্বর পঞ্চায়েতে ছবিটা অন্য। এ বারে ময়ূরেশ্বর ২ ব্লকের ৭টি পঞ্চায়েতের মধ্যে সর্বোচ্চ লিড দিয়েছে ওই পঞ্চায়েত। এই পঞ্চায়েত এলাকার বাসিন্দা নব নির্বাচিত ব্লক সভাপতি প্রমোদ রায়। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের সরকারের এত জনমুখী পরিকল্পনা সত্ত্বেও অন্যান্য পঞ্চায়েতে কেন আশানুরূপ লিড হল না, তা পর্যালোচনা করে দেখা হচ্ছে।’’
ভ্রম সংশোধন
‘বিধানসভা জয়, পুর-হারে ধাক্কা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে (আবাপ, বীরভূম সংস্করণ, পৃ ক১, ১২-০৬) ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের ফলে রামপুরহাট বিধানসভায় তৃণমূল ‘৮২,২১০ ভোটে এগিয়ে’ প্রকাশিত হয়েছে। তথ্যটি ভুল। ২০২৪ লোকসভার ভোটে তৃণমূল এই বিধানসভায় ৬,৯৬১টি ভোটে এগিয়ে আছে। অন্য দিকে, ‘বিপুল জয়েও অস্বস্তি দুই পঞ্চায়েতে’ শীর্ষক প্রতিবেদনে (আবাপ, বীরভূম সংস্করণ, পৃ ক১, ১১-০৬) ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের ফলে নানুর বিধানসভায় তৃণমূল ‘৭,৭৩১ ভোটে এগিয়ে ছিল’ লেখা হয়েছে। তথ্যটি ভুল। ২০১৯ লোকসভার ভোটে তৃণমূল এই বিধানসভায় ১৭,৭৩১টি ভোটে এগিয়ে ছিল। অনিচ্ছাকৃত এই ভুলগুলির জন্য আমরা দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী।