লোকসভা ভোটের প্রচারে কল্যাণীর জনসভা থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গোবরডাঙার বন্ধ গ্রামীণ হাসপাতাল নতুন করে চালুর আশ্বাস দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, গোবরডাঙার হাসপাতালটি কোভিড হাসপাতাল হয়েছিল। হাসপাতাল বন্ধ ছিল। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, পুরসভাকে দিয়ে সরকার থেকে নতুন করে হাসপাতালটি চালু করা হবে।
মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণায় গোবরডাঙার তৃণমূল নেতৃত্ব হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন। কারণ, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে যে কোনও ভোটে দলমত নির্বিশেষে গোবরডাঙা সব মানুষ দাবি তোলেন, বন্ধ গ্রামীণ হাসপাতালটি আবার পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল হিসাবে চালু করুক রাজ্য সরকার। হাসপাতাল চালু না হওয়ায় ভোটের প্রচারে তৃণমূল নেতৃত্বকে বিব্রত হতে হচ্ছিল। মুখ্যমন্ত্রীর হাসপাতাল চালুর ঘোষণার পরে স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব মনে করেছিলেন, এ বার লোকসভা ভোটের ফল তাঁদের অনুকূলে আসবে।
কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, ভোটের ফলাফলে মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাস কাজে আসেনি। গোবরডাঙা পুরসভার ওয়ার্ড সংখ্যা ১৭টি। তার মধ্যে ১৫টি ওয়ার্ডেই তৃণমূল পিছিয়ে রয়েছে। ৫ এবং ৬ নম্বরে কেবল তৃণমূল এগিয়ে। পুরপ্রধান শঙ্কর দত্ত এবং প্রাক্তন পুরপ্রধান সুভাষ দত্ত তাঁদের ওয়ার্ডে এগিয়ে। যদিও গত পুরভোটে তৃণমূল পেয়েছিল ১৫টি ওয়ার্ড। নির্দল ও বামেরা একটি করে আসন পেয়েছিল।
তৃণমূলের এই ফলের কারণ কী?
পুরপ্রধান শঙ্কর দত্ত বলেন, ‘‘এই ফলাফল আমাদের কাছে অকল্পনীয়। এই পরাজয়ের রহস্য এখনও বুঝতে পারছি না। আমাদের দিক থেকে চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। বাড়ি বাড়ি নিবিড় জনসংযোগও করা হয়েছিল।’’ তাঁর দাবি, সিপিএম তথা বামেদের ভোট বিজেপির দিকে চলে যাওয়ায় তৃণমূলের এই ফল হয়ে থাকতে পারে।
এ বার ভোটের প্রচারে তৃণমূলের মিটিং-মিছিল-জনসভায় ভিড় উপচে পড়েছিল। অভিনেতা দেব গোবরডাঙার প্রচারে এসেছিলেন। সে দিন জনজোয়ার দেখা গিয়েছিল। তৃণমূলের এক নেতার কথায়, ‘‘গোবরডাঙা হাসপাতাল নিয়ে মানুষের মধ্যে চোরা অসন্তোষ ছিল। মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাসের পরেও এই অসন্তোষ পুরোপুরি কাটানো যায়নি।’’ হাসপাতাল নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাসের পরে গোবরডাঙার একাংশের মানুষ জানিয়েছিলেন, তাঁরা স্টেট জেনারেল হাসপাতাল চান। পুরসভাকে দিয়ে হাসপাতাল চালানোর পক্ষপাতী তাঁরা নন। সিপিএমের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, আগেও মুখ্যমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু হাসপাতাল চালু হয়নি। ভোট এলেই হাসপাতাল চালুর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
২০১৪ সালের নভেম্বর মাস থেকে হাসপাতালে রোগী ভর্তি বন্ধ হয়ে যায়। বহির্বিভাগ খুঁড়িয়ে চলছিল। ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাস থেকে তা-ও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে হাসপাতালটি ‘করোনা হাসপাতাল’ হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল। পরিকাঠামো তৈরি করা হয়েছিল। করোনা রোগীর চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া হয়েছিল। বাসিন্দারা আশায় ছিলেন, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে রাজ্য সরকার আবারও পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল হিসাবে এটি চালু করবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি।
২০১৭ সালে মে মাসে ব্যারাকপুরে প্রশাসনিক সভায় গোবরডাঙার তৎকালীন পুরপ্রধান সুভাষ দত্ত এলাকায় থাকা একমাত্র হাসপাতাল চালু করতে মুখ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দেন, ওখানে হাসপাতাল হবে না।
তারপরে যমুনা দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। দলমত নির্বিশেষে এলাকার মানুষ ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছিলেন সে সময়ে। মিছিল, বন্ধ, সভা চলতে থাকে। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। দলীয় নির্দেশে পুরপ্রধানকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। পরে অবশ্য মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি গিয়ে তিনি পদ ফিরে পান।
প্রাক্তন পুরপ্রধান, সিপিএমের বাপি ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘প্রতিটি ভোটের আগে তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে হাসপাতাল চালুর আশ্বাস শুনে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন এখানকার মানুষ। ফলে এ বার আশ্বাসে কোনও কাজ হয়নি।’’ গোবরডাঙার বিজেপি নেতা আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "হাসপাতাল নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর মিথ্যা আশ্বাসে গোবরডাঙার সচেতন মানুষকে কেনা যাবে না। এ কথা মানুষ তাঁদের রায়ের মাধ্যমেই বুঝিয়ে দিয়েছেন।’’