• ‘কাজ করলে পদে থাকুন, নইলে রাস্তা দেখুন’, নবান্নে ক্যামাক স্ট্রিট মডেল চান অভিষেক! ভাবনায় ২০২৬
    আনন্দবাজার | ১৪ জুন ২০২৪
  • তৃণমূলের সেনাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বুধবার দুপুরে এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে পোস্ট করে জানিয়েছিলেন, চিকিৎসার কারণে তিনি সংগঠন থেকে ‘ছোট বিরতি’ নিচ্ছেন। তার পরে ২৪ ঘণ্টা কেটে গেলেও তৃণমূলে জল্পনা থামছে না। বিবিধ আলোচনার মধ্যে তৃণমূলের আলোচনায় বড় করে উঠে আসছে নবান্নের কাজকর্ম নিয়ে ক্যামাক স্ট্রিটের ‘অসন্তোষ’ প্রসঙ্গ। অভিষেকের ঘনিষ্ঠেরা ঘরোয়া আলোচনায় জানিয়ে দিচ্ছেন, সেনাপতি মনে করেন, সরকারের কাজ, কিছু মন্ত্রী এবং আমলার ‘শম্বুকগতি’ জনমানসে তৃণমূলের সরকার সম্পর্কে ‘নেতিবাচক’ ধারণা তৈরি করে দিচ্ছে। ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটের জন্য তা খুব ভাল সঙ্কেত নয়। কারণ, ওই বিধানসভা ভোটে তৃণমূলকে নামতে হবে ১৫ বছরের ‘প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা’র বোঝা ঘাড়ে নিয়ে। শুধুমাত্র দলীয় ‘সংগঠন’ দিয়ে তার মোকাবিলা করা কঠিন। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার মোকাবিলা করতে হবে সরকারের ‘পারফরম্যান্স’ দিয়ে।

    তৃণমূলে সকলেই জানেন, অভিষেক একমাত্র ‘পারফরম্যান্সে’ বিশ্বাস করেন। ‘কাজ করলে পদে থাকুন, নইলে রাস্তা দেখুন’ নীতি পুরোপুরি না হলেও সংগঠনের অনেকাংশেই কার্যকর করেছেন তিনি। এখন অভিষেক চান সেই নীতি সরকার এবং প্রশাসনেও কার্যকর হোক। নইলে সময়ের কাজ সময়ে হবে না। অভিষেকের ঘনিষ্ঠ এবং আস্থাভাজন এক নেতার কথায়, ‘‘উনি মনে করেন, ২০২৬ সালে মুখ্যসচিব বা স্বরাষ্ট্রসচিব ভোট চাইতে যাবেন না। ভোট করতে হবে সংগঠনকেই। কিন্তু তৃণমূল যখন পরের বিধানসভা ভোটে যাবে, তখন দলের মাথায় থাকবে ১৫ বছরের প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা। এখন থেকে যদি সময় বেঁধে কাজ না করা হয়, তা হলে শুধুমাত্র সংগঠন দিয়ে বিধানসভার বৈতরণী পার করা অসম্ভব!’’

    এ কথা ঠিক যে, অভিষেকের চোখে আবার একটি ছোট অস্ত্রোপচার হবে। সূত্রের খবর, তার পরে অভিষেক যাবেন দিল্লিতে সাংসদ হিসেবে শপথ নিতে। সেখান থেকে বিদেশে যাওয়ার কথা তাঁর। সেই ‘চিকিৎসাজনিত’ কারণেই তিনি সংগঠন থেকে ‘সাময়িক বিরতি’ নেবেন বলে বুধবার সমাজমাধ্যমে জানিয়েছেন।

    কিন্তু বুধবার থেকেই তৃণমূলে এই মর্মে জল্পনা এবং গুঞ্জন ছিল যে, চিকিৎসা ছাড়াও অভিষেকের পোস্টের ভাষায় স্পষ্ট যে, তাঁর কিছু ‘খেদ’ রয়েছে। ‘তৃণমূলে নবজোয়ার যাত্রা’র প্রসঙ্গ উল্লেখ করে অভিষেক তাঁর পোস্টে যা লিখেছিলেন, তা নিয়েও কৌতূহল তৈরি হয়েছিল শাসকদলের সর্ব স্তরে।

    দলের অন্দরে যে একাধিক জল্পনা ছিল, তা অভিষেকের ঘনিষ্ঠেরাও মেনে নিয়েছেন। তাঁরা এমনও মেনে নিচ্ছেন যে, জল্পনা থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু তাঁরা সবচেয়ে জোর দিচ্ছেন সরকারের একাংশের কাজকর্ম নিয়ে শাসকদলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের ‘অভিযোগ, অনুযোগ এবং খেদ’-এর উপর।

    তৃণমূল সূত্রের খবর, অভিষেক মনে করেন রাস্তা, পানীয় জল, আবাস, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য— এই মৌলিক পরিকাঠামোগত বিষয়গুলিতে মানুষকে পরিষেবা না দিলে বার বার ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ দিয়ে ভোটে জেতা যাবে না। অভিষেক-ঘনিষ্ঠ এক জনের বক্তব্য, ‘‘কিছু মন্ত্রী দফতরের কাজ মনিটর করেন না। কিছু আমলাও নিজেদের মতো চলেন। কাজ শুরু হলে তা কবে শেষ হবে, তার ঠিক থাকছে না। এই সংস্কৃতির বদল দরকার। এতে মানুষ বিরক্ত হচ্ছেন।’’ তাঁর ঘনিষ্ঠদের আরও দাবি, অভিষেক বিশ্বাস করেন সরকারের কাজ গতিশীল করতে কিছু মন্ত্রী এবং আমলার পদে দ্রুত বদল দরকার। ‘নিষ্ক্রিয়তা’র সংক্রমণ ঠেকানো না গেলে, পরিকল্পনা না থাকলে বিধানসভা ভোটে ‘বড় মূল্য’ চোকাতে হবে তৃণমূলকে।

    সূত্রের খবর, নিদেনপক্ষে মাস দুয়েকের ‘বিরতিতে’ যাচ্ছেন অভিষেক। যা খুব বেশি সময় না হলেও খুব কম সময়ও নয়। যা থেকে স্পষ্ট, আগামী ১০ জুলাই অনুষ্ঠিতব্য রাজ্যের চারটি বিধানসভার উপনির্বাচনে অভিষেক যুক্ত থাকছেন না। ফলে সেই প্রক্রিয়াতেও তিনি থাকতে চান না। এমনই বক্তব্য তাঁর ঘনিষ্ঠদের। পাশাপাশিই তাঁদের বক্তব্য, লোকসভা ভোটের প্রাথমিক পর্যালোচনায় যা উঠে এসেছে, তা নিয়েও দলের চিন্তাভাবনার প্রয়োজন রয়েছে বলে অভিষেক মনে করেন। ভোটের ফলাফলে বিজেপির চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি আসন পেলেও দেখা গিয়েছে শহর, মফস্‌সলে তৃণমূলের সমর্থনের ভিত খানিকটা আলগা হয়েছে। ফলে মনে করা হচ্ছে, শুধু মুসলিম ভোট দিয়ে বার বার জেতা যাবে না। দলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, ‘‘লক্ষ্মীর ভান্ডারকে বার বার কুমিরছানার মতো দেখানো হচ্ছে। একটা লক্ষ্মীর ভান্ডার দিয়ে একটা ভোট হয়। বার বার হয় না। এই সার সত্যটা বুঝতে হবে।’’ তাঁর কথায়, ‘‘অভিষেক চান, মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলি মেটাতে। যে চাহিদার কথা তিনি অনুধাবন করেছিলেন গত বছর নবজোয়ার যাত্রার সময়। মানুষ তাঁকে সেই কথাগুলোই সরাসরি বলেছিলেন।’’

    বুধবারের পোস্টে অভিষেক উল্লেখ করেছিলেন, ভোটের প্রচারে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, রাজ্য সরকার ডিসেম্বরের মধ্যে প্রাপকদের আবাস যোজনার বাড়ির টাকা দেবে। তা যাতে সময়ে কার্যকর হয়, সে ব্যাপারে তিনি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অনুরোধ করেছেন। শাসদকদলের এক নেতার বক্তব্য, জেলায় জেলায় প্রশাসনিক সভায় থেকে অনেক কাজের ঘোষণা হয়। কিন্তু নবান্নের সেই নির্দেশ কতটা কার্যকর হল, স্থানীয় স্তরে তার খোঁজ রাখা হয় না। যে যে দফতরে ‘শ্লথতা’ ছিল, এখনও সেই দফতরগুলিতেই সমস্যা রয়ে গিয়েছে। অথচ দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী-আমলারা নিজেদের পদে বহাল তবিয়তে রয়েছেন। তাঁদের জবাবদিহির কোনও বন্দোবস্ত নেই। তৃণমূলের অনেকের মতে, অভিষেকের বক্তব্যের ‘অভিমুখ’ খুব স্পষ্ট। তবে সেই অভিমুখে যে সংঘাতের বীজ রয়েছে, তা-ও একান্ত আলোচনায় মেনে নিচ্ছেন অনেকে। যে সংঘাত মূলত সরকার ও প্রশাসন পরিচালনার ‘দর্শন’ নিয়ে।

    অভিষেকের বিরতিতে যাওয়ার ঘোষণার পর আপাতত শাসদকদল এবং প্রশাসনে প্রশ্ন একটাই— নবান্নে কি কায়েম হবে ক্যামাক স্ট্রিটের ‘দর্শন’? না কি গত শীতের মতো ফের দূরে সরে থাকবেন তৃণমূলের সেনাপতি? আপাতত মাস দুয়েক অন্তরালে থেকে সেটাই যাচাই করতে চান অভিষেক। তার পরেই তিনি পরবর্তী পদক্ষেপ করবেন।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)