এলাকার ভোটারের প্রায় ৫২ শতাংশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। হাঁসন বিধানসভা কেন্দ্রের সেই সংখ্যালঘু ভোটকে এ বারেও ‘পাখির চোখ’ করেছিল তৃণমূল কংগ্রেস। কিন্তু, বীরভূম লোকসভা কেন্দ্রে এ বার বিপুল জয় পেলেও হাঁসনের সংখ্যালঘু ভোট লক্ষ্যণীয় ভাবে কম পেয়েছে শাসকদল। অন্তত গত বিধানসভা নির্বাচনের তুলনায় তো বটেই। নির্বাচনী পরিসংখ্যান থেকেই স্পষ্ট, সেই ভোটে এ বার থাবা বসিয়েছে বাম-কংগ্রেস জোট।
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বীরভূমের তৃণমূল প্রার্থী শতাব্দী রায় যখন তাঁর সাংসদ ক্ষেত্রের ৭টি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে দুবরাজপুর, সিউড়ি, সাঁইথিয়া ও রামপুরহাট, এই চারটি কেন্দ্রে বিজেপির থেকে পিছিয়ে পড়েছিলেন, তখন ‘খেলা ঘোরানো’ শুরু করেছিল হাঁসনই! সংখ্যালঘু অধ্যুষিত হাঁসন, নলহাটি এবং মুরারই বিধানসভা কেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত ভোট শতাব্দীকে জয়ী করেছিল। এবং ২০১৪ সালে তুলনায় তৃণমূলের জয়ের ব্যবধানও বেড়েছিল এই তিন কেন্দ্রের দৌলতে।
এ বার অবশ্য বীরভূম কেন্দ্রে বাম-কংগ্রেস জোটের পক্ষে জেলা কংগ্রেস সভাপতি মিল্টন রশিদ প্রার্থী হওয়ায় শাসকদলের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছিল। তাই সংখ্যালঘু ভোট যাতে ভাগ না-হয়, তার জন্য খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হাঁসন থেকেই বীরভূমে লোকসভার প্রচার শুরু করেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী ছাড়াও পূর্তমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুও প্রচারে এসে বারবার সংখ্যালঘু ভোট যাতে ভাগ না-হয়, তা দেখতে বলেছিলেন দলের নেতা-কর্মীদের।
লোকসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণার পরে দেখা গেল, হাঁসন বিধানসভা এলাকায় তৃণমূল জয়ী হলেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বড় অংশের ভোট ভাগ হয়ে কংগ্রেস প্রার্থীর ঝুলিতে গিয়েছে। রামপুরহাট ২ ব্লকের ৯টি, নলহাটি ২ ব্লকের ৬টি পঞ্চায়েত নিয়ে হাঁসন বিধানসভা কেন্দ্র। তৃণমূল ২০১৯ সালে ২৯ হাজার ৯১০ ভোটে এগিয়ে ছিল এখানে। এ বারের লোকসভা নির্বাচনে সেই ব্যবধান বেড়ে ৩৮ হাজার ৯৫৮ হয়েছে ঠিকই। কিন্তু, সেই ব্যবধান ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচন থেকে ১২ হাজার ভোট কম।
বিপরীতে বিধানসভা নির্বাচনে হাঁসনের বাম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী মিল্টন রশিদ পেয়েছিলেন ৩৯ হাজার ৮১৫ ভোট। এ বার হাঁসনে মিল্টনের প্রাপ্ত ভোট ৫২ হাজার ৬৪৩। প্রায় ১৩ হাজার ভোট বেশি। মিল্টন বলেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, ফিরহাদ হাকিম প্রচারে এসে আমাদের ভোট দিতে মানা করেছিলেন। কিন্তু, এলাকার মানুষের ভালবাসা, কর্মীদের নিঃস্বার্থ ও অক্লান্ত পরিশ্রমে আমরা আগের থেকে অনেক বেশি ভোট পেয়েছি।’’
ঘটনা হল, পঞ্চায়েত নির্বাচন থেকেই কংগ্রেস-সিপিএম জোটের হাঁসনে ভাল ফলের ইঙ্গিত মিলেছিল। গত বছর পঞ্চায়েত নির্বাচনে হাঁসন বিধানসভা কেন্দ্র থেকেই জেলা পরিষদের একমাত্র বিরোধী কংগ্রেস সদস্য জয়ী হন। নলহাটি ২ ব্লকের অধীন ৬ টি পঞ্চায়েতের মধ্যে ২টি পঞ্চায়েত জোট দখল করে। একটি পঞ্চায়েতে জোট ও বিজেপি মিলে বোর্ড গঠন করে। লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে নলহাটি ২ ব্লকের ৭০টি সংখ্যালঘু অধ্যুষিত গ্রামের মধ্যে কংগ্রেস প্রার্থী ৪৫টি গ্রামে তৃণমূলের থেকে এগিয়ে রয়েছেন। বিজেপি এই সমস্ত গ্রামে কোনও প্রভাব ফেলতে পারেনি। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের হাতছাড়া ৩টি পঞ্চায়েতের মধ্যে কংগ্রেস ও সিপিএমের দখলে থাকা বারা ১ পঞ্চায়েতেও এ বারে তৃণমূল এগিয়ে আছে। তেমনই ভদ্রপুর ১ পঞ্চায়েত বিজেপির থেকে পিছিয়ে আছে তৃণমূল। নলহাটি ২ ব্লকেও কংগ্রেস প্রার্থী এ বার ভাল পরিমাণ ভোট পেয়েছেন। সেটাও শাসকদলের চিন্তার কারণ।
এলাকার তৃণমূল কর্মীরা জানাচ্ছেন, পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে থেকে নলহাটি ২ ব্লকে স্থায়ী কোনও সভাপতি নেই। জেলা নেতৃত্বের গড়ে দেওয়া ৫ জনের কমিটিকে পরিচালনা করার মতো ব্লক নেতা না-থাকায় সংগঠন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কর্মীদের বড় অংশের বক্তব্য, এর পরেও স্থায়ী ব্লক সভাপতি করা না-হলে সংগঠনে আরও চিড় ধরবে। হাঁসন বিধানসভার দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা তথা দলের জেলা চেয়ারম্যান আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য বলেন, ‘‘হাঁসনে আমাদের ব্যবধান আগের বারের থেকে বেড়েছে। সুতরাং ফল ভাল হয়েছে।’’ নলহাটি ২ ব্লকে স্থায়ী সভাপতি খুব শীঘ্রই হবে বলেও তিনি জানান।
অন্য দিকে, বিজেপি গত বিধানসভায় হাঁসনে পেয়েছিল ৫৭ হাজার ৬৭৬ ভোট। এ বার তার থেকে হাজার দুয়েক কম পেয়েছে। কর্মীদের সক্রিয়তার অভাবই তাঁদের ভোট কমে যাওয়ার কারণ বলে দাবি করেছেন বিজেপির বীরভূম সাংগঠনিক জেলার সহ সভাপতি নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়।