কুয়েতের এক বহুতলে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড প্রাণ কেড়ে নিয়েছে ৪৫ জন ভারতীয়ের। রুটিরুজির টানে দেশছাড়া পরিযায়ী শ্রমিকদের নিথর দেহ কফিনবন্দি হয়ে দেশে ফিরেছে। বেশির ভাগের দেহের অধিকাংশই ঝলসে গিয়েছে। চেনার উপায় নেই। ডিএনএ পরীক্ষা করে জানতে হচ্ছে পরিচয়।
৪৫ জন ভারতীয়ের মধ্যে এ রাজ্যেরও এক বাসিন্দা ছিলেন। মেদিনীপুরের বাসিন্দা দ্বারিকেশ পট্টনায়েক শনিবার সকালে কুয়েত থেকে বাড়ি ফিরলেন কফিনবন্দি হয়ে। অনেক আশা বুকে নিয়ে কুয়েতে গিয়েছিলেন দ্বারিকেশের মতো শ্রমিকেরা, চোখে ছিল অনেক স্বপ্ন। বুধবার ভোরের আগুনে সেই স্বপ্ন, আশা পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে।
বুধবার ভোরে কুয়েতের রাজধানী শহরের দক্ষিণে মানগাফ এলাকায় এক বহুতলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছে গোটা বিশ্বকে। আগুনের ভয়াবহতা এতটাই ছিল যে প্রাণ বাঁচিয়ে পালাতে পারেননি অনেকেই। কেউ কেউ পালাতে পারলেও শরীরের বিভিন্ন অংশ ঝলসে গিয়ে বীভৎস আকার নিয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে এমন অনেকের।
তার পর থেকেই এই অগ্নিকাণ্ড নিয়ে হাজারো প্রশ্ন উঠছে। কী ভাবে আগুন লাগল? এমন অগ্নিকাণ্ড কি এড়ানো যেত না? সতর্কতার অভাব, না কি অগ্নিকাণ্ডের নেপথ্যে রয়েছে অন্য কারণ?
রুটিরুজির আশায় বিভিন্ন দেশ থেকে শ্রমিকেরা এসে কুয়েতে ভিড় করেন। বিভিন্ন সংস্থায় কাজ করেন তাঁরা। মূলত দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং আফ্রিকা থেকে শ্রমিকেরা কুয়েতে আসেন, থাকেন এবং জীবিকা নির্বাহ করেন।
অনেকের ধারণা, দেশের বাইরে গিয়ে কাজ করা মানেই উন্নত জীবন লাভ করা। কিন্তু বাস্তবে আদৌ তা নয়। থাকা থেকে খাওয়া— জীবনধারণের মৌলিক অধিকারগুলির মান বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিম্ন মানের হয়ে থাকে।
একটা ছোট্ট ঘরে ঠাসাঠাসি করে বাস করেন জনা দশেক শ্রমিক। সেখানেই খাওয়াদাওয়া, রান্নাবান্না। কুয়েতের যে বহুতলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, সেটাও ছিল তেমনই এক আবাসন। এক একটি ফ্ল্যাটে বাস করতেন সাত-আট জন করে শ্রমিক। ছোট্ট জায়গায় কোনও রকমে রাতের ঘুমটুকু সারতেন তাঁরা।
আগুন নেভার পর তদন্ত শুরু করে দমকল। ফরেন্সিক দল এসে নমুনা সংগ্রহও করে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম সূত্রের খবর, ওই আবাসনের নীচ তলায় নিরাপত্তারক্ষীর ঘরে প্রথমে আগুন লাগে। শর্ট সার্কিটের কারণেই এই অগ্নিকাণ্ড। দ্রুত সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
ওই আবাসনে মোট ১৯৬ জন বাসিন্দা থাকতেন। অগ্নিকাণ্ডের সময় সেখানে ছিলেন ১৭৯ জন। বাকি ১৭ জন কর্মসূত্রে বাইরে ছিলেন। ১৯৬ জনের মধ্যে ১৭৫ জনই ভারতীয়। বাকিরা ফিলিপিন্স, তাইল্যান্ড, পাকিস্তান এবং মিশরের বাসিন্দা।
এত জন শ্রমিক একসঙ্গে থাকায় ওই বাড়ি ‘মৃত্যুফাঁদে’ পরিণত হয়েছিল। কিন্তু তাতে ভ্রুক্ষেপ ছিল না কারও। ঘরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল বৈদ্যুতিন তারের জাল। ছিল না উপযুক্ত ওয়্যারিং ব্যবস্থা।
এক একটা ফ্ল্যাটে থাকার জায়গা এতটাই কম যে রান্না করার মতো উপযুক্ত কোনও ব্যবস্থা ছিল না। ছোট্ট এক কোণে কোনও রকমে রান্না সারতেন তাঁরা। দাহ্যপদার্থও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকত। ফলে সামান্য আগুনই ভয়াবহ আকার নিতে পারে। সেটাই হল কুয়েতে।
গোয়েন্দারা তদন্ত করে দেখেছেন, ওই আবাসনের বিভিন্ন ফ্ল্যাটে গ্যাস স্টোভ ব্যবহার করা হত। রান্নার বিভিন্ন সরঞ্জামও ছিল অনুন্নত। শুধু তা-ই নয়, ওই বিল্ডিংয়ে পর্যাপ্ত অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থাও ছিল না। সঙ্কীর্ণ সিঁড়ি। বিপদ ঘটলে ঘটনাস্থল ছাড়াই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ।
শুধু আগুনে ঝলসে মৃত্যু নয়। আগুন লাগার ফলে যে ধোঁয়া হয়, তাতেও শ্বাস বন্ধ হয়েও মৃত্যু হয়েছে কয়েক জনের। হাওয়া-বাতাস খেলার জায়গা ছিল না ওই ফ্ল্যাটগুলিতে। ফলে ধোঁয়া বার হওয়ার পথও ছিল অবরুদ্ধ।
কুয়েতে এ ধরনের ঘটনা এই প্রথম নয়। ২০১৮ সালে আল আহমাদির এমন এক ‘শ্রম শিবিরের’ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পাঁচ জনের মৃত্যু হয়েছিল। কম জায়গায় অতিরিক্ত মানুষের ভিড় এবং যথোপযুক্ত অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থার অভাবই ছিল সেই অগ্নিকাণ্ডের নেপথ্যের কারণ।
শুধু কুয়েত নয়, ২০১২ সালে কাতারের দোহায় শিল্পাঞ্চলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। সে বার ওই ঘটনায় ১১ জনের মৃত্যু হয়েছিল। শর্ট সার্কিটের কারণেই ওই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। ২০২০ সালে দোহায় আবারও এক শ্রম এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছিল।
২০১৫ সালে সৌদি আরবের রিয়াধেও এমন এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। ১০ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছিল সেই ঘটনায়। আহত হয়েছিলেন কয়েক ডজন শ্রমিক। জানা গিয়েছিল, রান্নাঘর থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ২০১৬ সালে আবু ধাবিতেও একই ভাবে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
জীবনযাত্রার অনুন্নত মানের জন্যই বার বার বিভিন্ন দেশের শ্রমিক এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু তাতেও বিশেষ হেলদোল দেখা যায় না।
অনেকে আবার এমন জীবনযাত্রার জন্য অবৈধ নিয়োগকেও দায়ী করছেন। শাহরুখ খান অভিনীত ‘ডাঙ্কি’ ছবি দেখে অনেকেরই ধারণা স্পষ্ট যে উপযুক্ত নথি ছাড়াও সীমান্ত পেরিয়ে কী ভাবে বিদেশে ভিড় করছেন ভিন্দেশের নাগরিকেরা।
নথি না থাকায় বিদেশে লুকিয়েই থাকতে হয় শ্রমিকদের। ফলে নির্দিষ্ট এলাকায় কম সুযোগ-সুবিধা, পরিষেবা বিহীন এলাকায় মানুষ থাকতে বাধ্য হন। কিছু ক্ষেত্রে ফিরে যাওয়ার পথও বন্ধ হয়ে যায়। অসহায়তা গ্রাস করে।
কুয়েতের ঘটনা আরও এক বার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল কী ভাবে মানুষ জীবনের মায়া ত্যাগ করে বিদেশে কাজ করছেন। নিজের জন্য সামান্য কিছু রেখে উপার্জনের বেশির ভাগ টাকাই পাঠিয়ে দেন নিজের বাড়িতে। আর অল্প টাকায় কোনও রকমে দিন কাটান!