প্রাচীন কাব্যে মহাভারতীয় যুগে গনগনিতে ভীমের হাতে বকাসুরের বধের কথা উল্লেখ থাকলেও, ইতিহাসবিদ ও ভূ-বিশেষজ্ঞদের মতে এর কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। পুরোটাই জনশ্রুতি। সেই জনশ্রুতি ধরেই পর্যটক টানার কৌশল গড়বেতার গনগনিতে। গনগনি পর্যটন কেন্দ্রের সংরক্ষিত এলাকায় সিমেন্টের বেদি করে বসানো হয়েছে মাটির নিচ থেকে প্রস্তরখণ্ডের আদলে পাওয়া এক ধরনের জীবাশ্ম। একটি নয়, পাশাপাশি দু’টি। গনগনি বেড়াতে আসা অনেকেই সেই স্থানে গিয়ে দীর্ঘক্ষণ ধরে দেখছেন সেই জীবাশ্ম, কেউ হাত দিয়ে স্পর্শ করে দেখছেন, ছবিও তুলছেন অনেকে। দেখার সঙ্গেই উঠে আসছে ভীম-বক রাক্ষসের সেই জনশ্রুতির কথাও।
কথিত রয়েছে, মহাভারতের যুগে এই স্থানে থাকত বকাসুর নামে এক বিরাট রাক্ষস। অজ্ঞাতবাস থাকার সময় পঞ্চপাণ্ডব এখানকার গভীর জঙ্গলে আসে। সেই সময় গনগনির প্রান্তরে বকাসুরের সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ বাঁধে দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীমের। ভীমের হাতে বধ হয় বকাসুর। অনেকের দাবি, মৃত্যুর পর বকাসুরের হাড় না কি এখনও মেলে গনগনির মাটি খুঁড়লে। যদিও ইতিহাসবিদ ও ভূ-বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এর কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই, পুরোটাই কল্পকাহিনী।
সেই জনশ্রুতি ধরেই পর্যটকদের আকৃষ্ট করার প্রয়াস দেখা যাচ্ছে গনগনি পর্যটন কেন্দ্রে। কেন এই উদ্যোগ? গনগনি দেখভাল করা ভারপ্রাপ্ত লিজ় সংস্থা বলছে, গনগনিতে ভীম-বকাসুরের যুদ্ধের কথা লোকমুখে ফেরে। তাই গনগনিতে বেড়াতে আসা অনেকেই বকরাক্ষসের হাড় খুঁজতে থাকে, অনেকে বাড়িও নিয়ে যান। আসলে হাড় তো নয়, একধরনের জীবাশ্ম, যা জলবায়ুর প্রভাবে হাড়ের মতো দেখতে হয়েছে। সেই জনশ্রুতির ‘হাড়’কে চাক্ষুস করতেই দু’টি জীবাশ্মকে একস্থানে বসিয়ে রাখা হয়েছে। যাতে পর্যটকদের আকর্ষণ আরও বাড়ে। লিজ় সংস্থার পক্ষে তারাশঙ্কর ঠাকুর বলেন, ‘‘গনগনিতে মাটি খুঁড়ে হাড়ের মতো দেখতে এই দু’টি জীবাশ্ম তুলে এনে এখানে রাখা হয়েছে যাতে মানুষ এখানকার ভূ-বৈচিত্র সম্পর্কে অবহিত হতে পারেন।’’
তবে বিতর্ক বেঁধেছে গনগনি পর্যটন কেন্দ্রের সংরক্ষিত এলাকার প্রবেশপথে একটি লেখা নিয়ে। যেখানে লেখা হয়েছে ‘বক রাক্ষসের হাড় সংরক্ষিত আছে’ বলে। লিজ় সংস্থার পক্ষে তারাশঙ্কর ঠাকুর বলেন, ‘‘এখনও লেখা চলছে, জনশ্রুতির কথাটাও লেখা হবে।’’ সমাজমাধ্যমে অনেকে এ নিয়ে সরব হয়েছেন। গড়বেতা ১ ব্লক প্রশাসন ও পঞ্চায়েত সমিতি অবশ্য এ বিষয়ে অবগত নয়।
ব্লক প্রশাসনের এক আধিকারিক ও পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতি সেবাব্রত ঘোষ বলেন, ‘‘জীবাশ্ম বসানোর বিষয়টি জানা নেই, খোঁজ নিয়ে দেখছি।’’ ইতিহাস নিয়ে চর্চা করা স্থানীয় অনেকে বলছেন, ‘‘জনশ্রুতির প্রসঙ্গ যেমন থাকবে, তেমনি কী ভাবে গনগনির অপরূপ ভূ-বৈচিত্র গড়ে উঠল, তার বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যাও তুলে ধরা হোক পর্যটকদের কাছে।’’
‘গনগনি-দ্য ল্যান্ড অফ ফায়ার’ বইয়ের লেখক ভূ-বিশেষজ্ঞ শুভেন্দু ঘোষ বলেন, ‘‘গনগনিতে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে রাসায়নিক আবহবিকারের ফলে প্রচুর প্রস্তরীভূত উদ্ভিদ জীবাশ্ম ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সে রকমই এই জীবাশ্ম এগুলি। জনশ্রুতিতে এগুলিই বকাসুরের হাড় বলে অনেকে মনে বলেন, যদিও এর কোনও বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা নেই।’’