বিনা মৃত্যুর যাত্রা কি শেষ? বুলেট ট্রেনের স্বপ্ন বন্দিছে ভারতীয় রেল! আমজনতার জন্য নিরাপত্তা কই?
আনন্দবাজার | ১৭ জুন ২০২৪
দুর্ঘটনা কমিয়ে শূন্যে আনার শপথ নিয়েছিল রেল। ২০১৬-১৭ সালে কেন্দ্রীয় রেল মন্ত্রক সেই ‘শপথের’ নাম দিয়েছিল ‘মিশন জিরো অ্যাক্সিডেন্ট’। তার পর থেকে ৭ বছর অতিবাহিত। রেলের দুর্ঘটনার ‘গ্রাফ’ বলছে, বছর দু’য়েক সেই ‘মিশন’ লাইনে চললেও ২০২২ সালের পর থেকে আচমকাই বেলাইন হয়ে গিয়েছে। ভারতীয় রেল দুর্ঘটনা ‘শূন্য’ তো হয়ইনি উল্টে এক লাফে কয়েক ধাপ বেড়েছে রেল দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা।
‘মিশন জিরো অ্যাক্সিডেন্ট’ চালু হওয়ার দু’বছর পরে ২০১৯ সালে রেলদুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা কমে শূন্যে এসে দাঁড়িয়েছিল। ভারতীয় রেলের ইতিহাসে এই বছরটিই ছিল নিরাপদতম বছর। অথচ তার ঠিক চার বছর পরে ২০২৩ সালে আচমকাই ‘আকাশ ছোঁয়’ রেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা।
গত বছর অক্টোবরে অন্ধ্রপ্রদেশে ট্রেনে দুর্ঘটনায় ১৪ জন মারা যান। গত জুনে ওড়িশায় করমণ্ডল এক্সপ্রেসে দুর্ঘটনায় মারা যান ২৯৬ জন। এ ছাড়াও ২০২৩ সাল জুড়ে ছোট বড় মিলিয়ে না হোক ১৮টি রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। কখনও চলন্ত ট্রেনে লেগেছে আগুন। কখনও বেলাইন হয়েছে বগী। আবার সিগন্যালিংয়ের গন্ডগোলেও ঘটেছে দুর্ঘটনা। হিসাব বলছে শুধু ২০২৩ সালেই সাড়ে তিনশোর বেশি মানুষ মারা গিয়েছেন রেল দুর্ঘটনায়। আর ২০২৪ সালের প্রথম ছ’মাসে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনা ধরলে এখনও পর্যন্ত দশ জনের মৃত্যু হয়েছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে যে রেল ‘জিরো অ্যাক্সিডেন্ট’ প্রকল্প নিয়ে দু’ বছরের মধ্যে দুর্ঘটনার সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে এনেছিল, সেই রেল পরবর্তী চার বছরে এই জায়গায় পৌঁছল কী করে?
জবাবে রেলেরই প্রাক্তন কর্মী বলছেন, ‘‘বেশি ভাড়ার প্রিমিয়াম ট্রেনের বিলাস আর স্বাচ্ছন্দ্যে নজর দিতে গিয়ে কম ভাড়ার ট্রেন গুলির প্রাথমিক সুরক্ষা নিয়ে উদাসীন হয়ে পড়ছে রেল’’। কিছুটা ব্যাখ্যা করে তিনি এ-ও বলেছেন, ‘‘বন্দে ভারতের মতো ট্রেনে সফর করার ন্যূনতম ভাড়া হল ১১০০-১২০০ টাকা। সেখানে এই ধরনের ট্রেন গুলিতে ১০০-২০০ টাকার টিকিট কেটেই অনেকটা পথ চলে যাওয়া যায়। হয়তো তাই রেল কম ভাড়ার ট্রেনগুলির প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ করছে!’’
নেহাত কথার কথা নয়। কাকতালীয় ভাবে এই বক্তব্যের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে কিছু সংখ্যা, রেলের ঘোষণা এবং কিছু সময়ের আনুপাতিক হিসাবও।
২০১৬-১৭ সালে ‘জিরো অ্যাক্সিডেন্ট’ মিশনের ঘোষণা করে রেল বলেছিল, এখন থেকে রেল গুরুত্ব দেবে নিয়মিত রেল লাইন রক্ষণাবেক্ষণে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিক নিয়মে রেল লাইন দুর্বল হতে শুরু করে। লাইনের উপর দিয়ে কত ট্রেন চলছে, কত ভারবাহী ট্রেন চলছে তার উপরে নির্ভর কত দিন অন্তর রেললাইন ঠিক করা দরকার। ঠিক না হলে ওই লাইনের উপর দিয়ে কত গতিতে কত ভারী ট্রেন চালানো যাবে, সে ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এই সমস্ত কিছুর উপরে নজরদারির জন্যই রেল জোর দিয়েছিল রেল সুরক্ষার আধুনিকীকরনে।
পরিকল্পনায় বলা হয়েছিল, দুর্ঘটনা এড়াতে সিগন্যালিং সিস্টেমে এবং দুর্ঘটনা প্রতিহত করতে সক্ষম এলএইচবি রেলবগী ও আধুনিক ইঞ্জিন ব্যবহার করা হবে। তার জন্য রাষ্ট্রীয় রেল সংরক্ষা কোষে ১ লক্ষ কোটি টাকা নির্ধারণও করেছিল রেল। বলা হয়েছিল, পাঁচ বছর ধরে ওই অর্থ খরচ করা হবে রেলসুরক্ষার স্বার্থে। কিন্তু চার বছর পর ২০২১ সালে দেখা গেল পরিস্থিতির উন্নতি তো হয়ইনি বরং আবার অবনতি হতে শুরু করেছে।
২০২১ সাল থেকেই আবার বাড়তে শুরু করে রেল দুর্ঘটনা। ২০২৩ সালের দুর্ঘটনার সংখ্যা বিগত ২০ বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। কাকতালীয় ভাবে ২০২২ সালের শেষ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত গোটা দেশে অজস্র প্রিমিয়াম ট্রেন পরিষেবা চালু হয়। বন্দে ভারত, তেজস উদয় এক্সপ্রেসের পাশাপাশি দেশের সম্পন্ন মানুষকে বুলেট ট্রেনের স্বপ্নও দেখায় রেল। রেলের বাৎসরিক বাজেটও বাড়ে।
রেল বাজেটের তথ্য বলছে, বিভিন্ন প্রিমিয়াম ট্রেন পরিষেবা গুলির মধ্যে একা বন্দে ভারতের জন্যই রেল বাজেটে বরাদ্দ করা হয়েছে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা। এক একটি বন্দে ভারত ট্রেন বানাতে খরচ হয়েছে প্রায় ১০৫ কোটি টাকা করে। এর পাশাপাশি বন্দে ভারতের উপযুক্ত লাইন তৈরির জন্যও খরচ হয়েছে কোটি কোটি টাকা। গত ২০২২ এর সেপ্টেম্বর মাস থেকে ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত ৪৯টি রুটে বন্দে ভারত এক্সপ্রেস চালু করা হয়েছে।
রেলের ওই প্রাক্তন কর্তা বলছেন, বন্দে ভারতের এক একটি বগী তৈরি করতে খরচ হচ্ছে সাড়ে ছ’ কোটি টাকা করে। অথচ সোমবার যে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে দুর্ঘটনা ঘটেছে, দেখা যাচ্ছে তাতে এখনও ব্যবহার হয়েছে আইএসএফ বগি। উত্তর- পূর্ব সীমান্ত রেলের স্বল্প দূরত্বের ট্রেনে যেখানে অত্যাধুনিক এলএইচবি কোচ দেওয়া হয়েছে সেখানে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের জন্য বরাদ্দ সেই পুরোনো কোচ কেন?
রেলের প্রাক্তন কর্তার বক্তব্য, ‘‘বেশ কয়েক বছর আগেই রেল বোর্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, পুরনো প্রযুক্তির কামরা (কনভেনশনাল কোচ) তৈরি পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হবে। দেশের সব ট্রেনেই ধীরে ধীরে পুরনো কামরা পাল্টে (লিঙ্ক হফম্যান বুশ বা এলএইচবি) প্রযুক্তির উন্নত কামরা লাগানো হবে। নতুন প্রযুক্তির ওই কামরার জোগান বাড়াতে চেন্নাইয়ের ‘ইন্ট্রিগ্রাল কোচ ফ্যাকট্রিতে’ শুধু এলএইচবি কামরা তৈরি করা হবে। কিন্তু বছর সাতেক পরেও সব ট্রেনে যে এলএইচবি কামরা হয়নি, তা স্পষ্ট।’’
তাঁর কথায়, এলএইচবি হল দুর্ঘটনা প্রতিরোধক বগী। সামনাসামনি দুই ট্রেনের ধাক্কা লাগলে একটি কামরা আর একটি কামরায় ঢুকে যাবে না। এমনকি, একটি কামরা আর একটির উপরে উঠেও যাবে না। ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে গেলে কামরাগুলি যেমন তেমন ভাবে উল্টে পাল্টে যাবে না। যেমনটা কাঞ্চনজঙ্ঘায় হয়েছে! রেলের প্রাক্তন কর্তা বলছেন, এলএইচবি বগি থাকলে এই দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য হত। ঠিক যেমন গত বছর জুন মাসে করমণ্ডল এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনাও ঘটত না।
কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে বুলেট এবং বন্দে ভারতের মতো প্রিমিয়াম ট্রেনের স্বপ্নে বন্দিত ভারতীয় রেল কাঞ্চনজঙ্ঘার মতো ট্রেনের সাধারণ যাত্রীদের প্রাথমিক সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে।