চার বছরে ২৬টি দুর্ঘটনা! সংঘর্ষ থেকে অগ্নিকাণ্ড, বহু মৃত্যুর সাক্ষী ভারতীয় রেল, কী ভাবে বিপর্যয়?
আনন্দবাজার | ১৭ জুন ২০২৪
সোমবার সকাল। ঘড়ির কাঁটায় ৯টা বাজতে তখনও মিনিট দশেক বাকি। শিয়ালদহের দিকে যাওয়ার পথে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস। মালগাড়ির ধাক্কায় ট্রেনের পিছন দিকের দু’টি কামরা লাইনচ্যুত হয়েছে বলে খবর। দুর্ঘটনার অভিঘাত এতটাই যে, একটি কামরা লাইন থেকে উপরে উঠে গিয়েছে। অন্যটি দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছে। এই দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে কমপক্ষে ৮ যাত্রীর। আহত বহু।
স্থানীয় সূত্রে খবর, নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে সোমবার সকালে নির্ধারিত সময়েই রওনা দিয়েছিল কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস। নীচবাড়ি এবং রাঙাপানি স্টেশনের মাঝে দুর্ঘটনাটি ঘটে। পিছন দিক থেকে একটি মালগাড়ি এসে ওই ট্রেনে ধাক্কা মারে বলে খবর। সংঘর্ষের তীব্রতায় কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের পিছন দিক থেকে পর পর দু’টি কামরা লাইনচ্যুত হয়।
ঠিক এক বছর আগে, অর্থাৎ গত বছরের জুন মাসে এ রকমই এক দুর্ঘটনার মুখে পড়েছিল করমণ্ডল এক্সপ্রেস। সেই ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল প্রায় ৩০০ জন যাত্রীর।
করমণ্ডল এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনাটি ঘটে ২০২৩ সালের ২ জুন। ঘড়ির কাঁটায় তখন সন্ধ্যা প্রায় ৭টা। ওড়িশার বালেশ্বরের বাহানগায় মালগাড়ির সঙ্গে সংঘর্ষে লাইনচ্যুত হয় করমণ্ডল এক্সপ্রেস। ২৯৬ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন ওই দুর্ঘটনায়। আহত হয়েছিলেন প্রায় ১২০০ জন।
শুধু করমণ্ডল এক্সপ্রেস নয়, ২০২৩ সালে ছোট-বড় মিলিয়ে মোট ১৭টি রেল দুর্ঘটনা হয়েছে ভারতে। গত চার বছরের হিসাবে সেই সংখ্যা অনেক বেশি।
এক নজরে দেখে নেওয়া যাক, ২০২১ সাল থেকে কত বার দুর্ঘটনার মুখে পড়েছে ভারতীয় রেল।
২০২১ সালে মোট পাঁচটি দুর্ঘটনার মুখে পড়ে ভারতীয় রেল।
২০২১ সালের ১৭ জানুয়ারি। কেরলের ইদাভাই রেলওয়ে স্টেশনের কাছে ভারকালা এবং পারাভুরের মাঝে মালাবার এক্সপ্রেসের পণ্যবাহী কামরায় আগুন ধরে যায়। যদিও আগুন লাগার কারণে কোনও হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
২০২১ সালের ৭ মে তেলঙ্গানার মেহবুবাবাদ স্টেশনের কাছে কোনার্ক এক্সপ্রেসের ধাক্কায় মৃত্যু হয় মহম্মদ পাশা (৪০) এবং এ কমলাকার চারি (৩৬) নামের দুই রেলকর্মীর। মৃতেরা রেলের ‘ট্র্যাকম্যান’ হিসাবে কাজ করতেন। রেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিলেন, ডাউন লাইনে ১ নম্বর ট্র্যাকে রঙের কাজ চলছিল। ট্রেনের শব্দ শুনতে পেয়ে তাঁরা ২ নম্বর ট্র্যাকে চলে যান। তখনই কোনার্ক এক্সপ্রেস এসে ধাক্কা মারে তাঁদের। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় দু’জনের।
২০২১-এর ১ জুন দক্ষিণ রেলের আম্বুর স্টেশনের কাছে সিগন্যাল মেরামত করার সময় মালগাড়ির ধাক্কায় দুই রেলকর্মীর মৃত্যু হয়। রেল জানিয়েছিল, প্রবল বৃষ্টির কারণে ওই দুই কর্মী ট্রেন আসার আওয়াজ পাননি। বৃষ্টির কারণে দৃশ্যমানতা কম থাকায় চালকও ওই দুই কর্মীকে দেখতে পাননি। ওই বছরেরই ২৫ অগস্ট লাইনচ্যুত হয় গুয়াহাটি-হাওড়া সরাইঘাট কোভিড স্পেশ্যাল ট্রেন। ট্রেনটির প্যান্ট্রি-সহ চারটি কামরা ছায়াগাঁও স্টেশনের কাছে লাইনচ্যুত হয়।
২০২২ সালে ভারতীয় রেল তিনটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। ওই বছরের ১৩ জানুয়ারি বিকেল ৫টা নাগাদ নিউ ময়নাগুড়ি এবং নিউ দোহমনি স্টেশনের মাঝামাঝি লাইনচ্যুত হয় বিকানের-গুয়াহাটি এক্সপ্রেস। ওই ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল ৯ জন যাত্রীর। আহত হন কমপক্ষে ৪০ জন।
২০২২ সালের ৩ এপ্রিল নাসিকের কাছে লাইনচ্যুত হয় পবন এক্সপ্রেস। এই ঘটনায় দু’জন যাত্রী আহত হয়েছিলেন।
২০২২ সালের ২৫ মার্চ নবসারি এবং মারোইল স্টেশনের মাঝে মুম্বই-নয়াদিল্লি দুরন্ত এক্সপ্রেসের ধাক্কায় মৃত্যু হয় দুই রেলকর্মীর।
২০২৩ সালে ভারতে রেল দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল ১৭টি। যার মধ্যে জুন মাসেই ছ’টি দুর্ঘটনা ঘটেছিল। সব থেকে বড় দুর্ঘটনার মুখে পড়ে করমণ্ডল।
২০২৩-এর ২ জানুয়ারি ভোর ৪টে নাগাদ, রাজস্থানের মারওয়ার স্টেশন ছাড়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে সূর্যনগরী এক্সপ্রেস। লাইনচ্যুত হয় ১১টি কামরা। এই ঘটনায় আহত হন ১০ জন যাত্রী।
ওই বছরের ৩ এপ্রিল কেরলের কান্নুরগামী একটি এক্সপ্রেসে আট সহযাত্রীর গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে এক যাত্রীর বিরুদ্ধে। পরে, একটি দুই বছর বয়সি শিশু কন্যা-সহ তিন জনের দেহ লাইন থেকে উদ্ধার হয়। সেই ঘটনায় যাত্রী সুরক্ষা নিয়ে রেল কর্তৃপক্ষের দিকে আঙুল উঠেছিল।
২০২৩ সালের ১৫ মে বেঙ্গালুরুগামী চেন্নাই-বেঙ্গালুরু ডাবল ডেকার এক্সপ্রেসের একটি কামরা বেঙ্গালুরু অভিমুখে বিসনাট্টম স্টেশনের কাছে লাইনচ্যুত হয় সাড়ে ১১টা নাগাদ। যদিও ওই ঘটনায় হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
এর পর ২ জুন দুর্ঘটনার কবলে পড়ে করমণ্ডল এক্সপ্রেস। পরের দুর্ঘটনাটি ঘটে এর ছ’দিন পর, ৮ জুন। দুপুর ৩টে নাগাদ উটি থেকে মেট্টুপালায়ামগামী নীলগিরি মাউন্টেন রেলের একটি কামরা কুন্নুরের কাছে লাইনচ্যুত হয়। এর এক দিন পরেই লাইনচ্যুত হয় বিজয়ওয়াড়া-চেন্নাই সেন্ট্রাল জনশতাব্দী এক্সপ্রেসের একটি কামরা। চেন্নাই সেন্ট্রাল থেকে কারশেডের দিকে যাচ্ছিল ওই ট্রেন। এর দু’দিন পর আবার চেন্নাই সেন্ট্রাল থেকে তিরুভাল্লুর যাওয়ার পথে লোকাল ট্রেনের একটি কোচ বেসিন ব্রিজ স্টেশনের কাছে লাইনচ্যুত হয়। ২২ জুন চেন্নাই থেকে মুম্বইগামী লোকমান্য তিলক এক্সপ্রেসের একটি কামরায় আগুন ধরে যায়।
২০২৩-এর ২৫ জুন বাঁকুড়ার ওন্দাগ্রাম স্টেশনের কাছে লুপ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মালগাড়িকে পিছন দিক থেকে সজোরে ধাক্কা মারে অন্য একটি মালগাড়ি। ঘটনায় চলন্ত মালগাড়ির ইঞ্জিন-সহ বেশ কয়েকটি বগি বেলাইন হয়ে ছিটকে পড়ে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় দু’টি মালগাড়ির মোট ১৩টি বগি। রেল সূত্রে খবর, এই দুর্ঘটনার জেরে রেলের ১০০ কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছিল। তবে করমণ্ডলের দুর্ঘটনা ছাড়া, ২০২৩ সালের জুন মাসে ঘটা বাকি পাঁচটি ট্রেন দুর্ঘটনার একটিতেও কোনও হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
২০২৩-এর ৭ জুলাই তেলঙ্গানার ইয়াদাদ্রি-ভুবনগিরি জেলার বোমাইপল্লি এবং পাগিদিপল্লির মধ্যে হাওড়াগামী ফলকনামা এক্সপ্রেসের তিনটি কামরায় আগুন লাগে। যদিও হতাহতের সংখ্যা ছিল শূন্য।
২৬ অগস্ট ভোর সাড়ে ৫টা নাগাদ মাদুরাই স্টেশনের কাছে লখনউ-রামেশ্বরম ভারত গৌরব ট্রেনের একটি কামরায় আগুন ধরে যায়। দ্রুত সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। সেই ঘটনায় ৯ জনের মৃত্যু হয়েছিল। আহতের সংখ্যা ছিল ২০ জনেরও বেশি। রেলের তরফে জানানো হয়েছিল, এক্সপ্রেস ট্রেনের ওই কামরাটি ব্যক্তিগত ভাবে ভাড়া নেওয়া হয়েছিল। ওই কামরার যাত্রীরা আসছিলেন লখনউ থেকে। কামরায় একটি গ্যাস সিলিন্ডার ছিল। সেখানেই আগুন লেগে বিপত্তি হয়।
২০২৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ভালসাদ স্টেশন অতিক্রম করার সময় তিরুচিরাপল্লী-শ্রী গঙ্গানগর হামসফর এক্সপ্রেসের দু’টি কামরায় আগুন ধরে যায়। তবে সেই ঘটনায় কেউ মারা যাননি। এর তিন দিন পরে, অর্থাৎ ২৬ সেপ্টেম্বর রাতে একটি লোকাল ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে মথুরা স্টেশনের ২এ প্ল্যাটফর্মে উঠে যায়।
১১ অক্টোবর রাত ১০টা নাগাদ আনন্দ বিহার টার্মিনাল-কামাখ্যা জংশন নর্থ-ইস্ট এক্সপ্রেসের ছ’টি কামরা বিহারের বক্সার জেলার রঘুনাথপুর স্টেশনের কাছে লাইনচ্যুত হয়। সেই ঘটনায় নিহত হন চার যাত্রী। আহতও হন ৭০ জনের বেশি।
এর পর ২৯ অক্টোবর রাত ৯টার একটু পরে অন্ধ্রের কোট্টভালাসা স্টেশনের কাছে বিশাখাপত্তনম-রায়গাদা এবং বিশাখাপত্তনম-পালাসা প্যাসেঞ্জার ট্রেনের সংঘর্ষে ১৪ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন প্রায় ৫০ জন।
এর দু’দিন পরে গাজিপুর থেকে দিল্লির আনন্দ বিহারগামী সুহেলদেও সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস উত্তরপ্রদেশের প্রয়াগরাজের কাছে লাইনচ্যুত হয়। এর পরের মাসে উত্তরপ্রদেশের ইটাওয়ার কাছে দিল্লি-দ্বারভাঙা সুপারফাস্ট এক্সপ্রেসে আগুন ধরে যায়। এই দুই ঘটনাতেই কেউ মারা যাননি। তবে বেশ কয়েক জন যাত্রী আহত হন।
২০২৪ সালে এখনও পর্যন্ত দু’টি রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২৮ ফেব্রুয়ারি ঝাড়খণ্ডের জামতাড়ায় একটি দুর্ঘটনা ঘটে পূর্ব রেলের আসানসোল ডিভিশনের বিদ্যাসাগর ও কাশিটার স্টেশনের মাঝে। লোকাল ট্রেনের ধাক্কায় দু’জন যাত্রীর মৃত্যু হয়। ডাউন অঙ্গ এক্সপ্রেসে আগুন লেগেছে বলে ভুয়ো খবর যাত্রীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এর পর যাত্রীরা চেন টেনে অঙ্গ এক্সপ্রেস থামিয়ে দেন বলে খবর। ট্রেন থেকে নেমে রেললাইন ধরে হাঁটার সময় আসানসোল-ঝাঝা লোকাল ট্রেনের ধাক্কায় দু’জনের মৃত্যু হয়। আহতও হন অনেকে।
এর পরেই সোমবার সকালে দুর্ঘটনার তবলে পড়ল কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস। স্থানীয় সূত্রে খবর, নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে সোমবার সকালে নির্ধারিত সময়েই রওনা দিয়েছিল ট্রেনটি। নীচবাড়ি এবং রাঙাপানি স্টেশনের মাঝে দুর্ঘটনা ঘটে। সেই ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে কমপক্ষে ৮ জনের।