• ‘কবচ’ ছিল না, সেই কারণেই কি দুর্ঘটনা কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে! কী এই প্রযুক্তি?
    আনন্দবাজার | ১৭ জুন ২০২৪
  • কলকাতাগামী কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস এবং একটি মালগাড়ির সংঘর্ষে মারা গিয়েছেন অন্তত ৯ জন। আহত প্রায় ৪১। তার পরেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, কী ভাবে হল এই দুর্ঘটনা? তা হলে কি ‘কবচ’ ছিল ওই লাইনে? এই ‘কবচ’ কী? উঠছে এ রকম অসংখ্য প্রশ্ন।

    গত বছরের জুনে ওড়িশার বালেশ্বরের বাহানগার কাছে করমণ্ডল এক্সপ্রেস এবং একটি মালগাড়ির মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছিল। তারই যেন পুনরাবৃত্তি ঘটল সোমবার সকালে শিলিগুড়ির কাছে।

    ত্রিপুরার আগরতলা থেকে শিয়ালদহের দিকে আসছিল কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস। স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ব্যবস্থা খারাপ থাকায় নীচবাড়ি এবং রাঙাপানি স্টেশনের মাঝে খুবই ধীর গতিতে চলছিল ট্রেনটি।

    কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস যে লাইনে চলছিল, পিছন থেকে একটি মালগাড়ি সজোরে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের পিছনে ধাক্কা মারে। খেলনার মতো মালগাড়ির উপর উঠে পড়ে এক্সপ্রেসের পিছনের একাধিক কামরা। লাইনচ্যুত হয় মালগাড়িও।

    প্রশ্ন উঠছে, তা হলে কি কবচ ছিল না? কবচ ভারতে তৈরি একটি প্রযুক্তি। একই লাইনে দু’টি ট্রেন চললে দুর্ঘটনা এড়াতে সাহায্য করে কবচ।

    এই দুর্ঘটনার পর রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবের একটি ভিডিয়ো প্রকাশ্যে এসেছে, যেখানে তিনি বোঝাচ্ছেন, এই কবচ আসলে কী? এর পরেই প্রশ্ন উঠছে, কেন ওই ট্রেন দু’টিতে বা লাইনে লাগানো ছিল না কবচ? রেলের সূত্রে জানা গিয়েছে, এখনও বহু লাইনেই লাগানো হয়নি কবচ।

    রেল বোর্ডের চেয়ারম্যান জয়া বর্মা সিংহ এনডিটিভি-কে বলেছেন, ‘‘দিল্লি-গুয়াহাটি রুটে সুরক্ষা ব্যবস্থা বসানোর পরিকল্পনা রয়েছে রেলের। আগামী বছরের মধ্যে ৬০০০ কিলোমিটার লাইনে এই ব্যবস্থা মোতায়েনের কাজ শেষ করার লক্ষ্য রয়েছে রেলের।’’

    জয়া আরও বলেন, ‘‘চলতি বছর ওই দিল্লি-গুয়াহাটি পথে ৬০০০ কিলোমিটার লাইনের মধ্যে ৩০০০ কিলোমিটার লাইনকে কবচ সুরক্ষার আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে রেলের। তা হলে সুবিধা পাবে পশ্চিমবঙ্গও। দিল্লি-হাওড়া রুটে বসানো হবে এই কবচ সুরক্ষা।’’

    ভারতে রেললাইনের দৈর্ঘ্য এক লক্ষ কিলোমিটারেরও বেশি। তার মধ্যে এখনও পর্যন্ত মাত্র ১,৫০০ কিলোমিটার লাইনের উপর কবচ ব্যবস্থা রয়েছে। ২০২২-২৩ সালে ২০০০ কিলোমিটার দীর্ঘ লাইনকে এই কবচ ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা ছিল। মোট ৩৪ হাজার কিলোমিটার রেললাইনকে এই সুরক্ষার আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা রয়েছে।

    রেল বোর্ডের প্রাক্তন এগ্‌জ়িকিউটিভ ডিরেক্টর প্রেমপাল শর্মা জানিয়েছেন, লাইনে কবচ সুরক্ষা বসানো হলে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো যাবে। রেল সূত্রে জানা গিয়েছে, এই কবচ ব্যবস্থার জন্য খরচ হতে পারে ১৬ কোটি ৮৮ লক্ষ টাকা।

    কবচ আসলে কী? অনেকেরই বিশ্বাস, শরীরে কবচ ধারণ করলে বিপদ-আপদ থেকে মুক্তি মেলে। তেমনই লাইনে কবচ লাগানো থাকলেও এড়ানো সম্ভব দুর্ঘটনা। কবচ হল অটোমেটিক ট্রেন প্রোটেকশন (এটিপি) সিস্টেম। তিনটি ভারতীয় সংস্থার সঙ্গে মিলে এই প্রযুক্তি তৈরি করেছে রিসার্চ ডিজ়াইন অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ডস অর্গানাইজ়েশন (আরএসসিও)।

    ২০২০ সালে কবচকে জাতীয় স্বয়ংক্রিয় ট্রেন সুরক্ষা ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সর্বোচ্চ সুরক্ষা স্তরের পরীক্ষাতেও সবুজ সঙ্কেত পায় এই প্রযুক্তি। এটি ট্রেনের গতি নিয়ন্ত্রণ করে স্বয়ংক্রিয় ভাবে। এর ফলে দৃশ্যমানতা কম থাকলেও চলতে পারে ট্রেন। মুখোমুখি সংঘর্ষ এড়ানো সম্ভব। চালককে সতর্ক করে দেয়।

    কী ভাবে সংঘর্ষ এড়ায় এটি? একই লাইনের উপর দু’টি ট্রেনের উপস্থিতি নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকেই বুঝতে পারে ‘কবচ’। সেই অনুযায়ী সে আগেভাগে ট্রেনের চালককে সতর্ক করে দেয়। চালক সময় মতো ব্রেক কষতে না পারলেও কবচ প্রযুক্তি স্বয়ংক্রিয় ভাবে ব্রেক কষে গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণ করে।

    রেলের তরফে জানানো হয়, ‘কবচ’ প্রযুক্তিতে রয়েছে মাইক্রো প্রসেসর, গ্লোবাল পজ়িশনিং সিস্টেম এবং রেডিয়ো সংযোগব্যবস্থা। যাবতীয় আধুনিক প্রযুক্তি ‘কবচ’-এ ব্যবহার করা হয়েছে।

    এই প্রযুক্তিতে রেললাইন, স্টেশন, সিগন্যালের কাছে বসানো থাকে রেডিয়ো ফ্রিকোয়েন্সি আইডেন্টিফিকেশন (আরএফআই)। সেই যন্ত্র ট্রেনের অবস্থান এবং গতি চিহ্নিত করে।

    এই যন্ত্র সক্রিয় থাকলে একই লাইনে দু’টি ট্রেন চলে এলে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হয়। কী ভাবে? একই লাইনে একটি ট্রেনের ৫ কিলোমিটার দূরে অন্য একটি ট্রেন চলে এলে, এই প্রযুক্তির কারণে একটি ট্রেন নিজে থেকে দাঁড়িয়ে পড়ে। দ্বিতীয় ট্রেনটি দূরে না চলে যাওয়া পর্যন্ত থেমে থাকে প্রথমটি।

    অন বোর্ড ডিসপ্লে অফ সিগন্যাল অ্যাসপেক্ট (ওবিডিএসএ)-এর কারণে দৃশ্যমানতা কম থাকলেও সিগন্যাল দেখতে সমর্থ হন চালক। ঝড়বৃষ্টি, কুয়াশার মধ্যেও এ ক্ষেত্রে সমস্যা হয় না। জানলার বাইরে চালক উঁকি দিলেই সতর্ক হতে পারেন তিনি।

    দু’টি ট্রেন একই লাইনে চলে এলে ইঞ্জিনে বসানো একটি যন্ত্রের মাধ্যমে অনবরত সিগন্যাল দিতে থাকে কবচ। যা চালকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করেন তিনি।

    রেল জানিয়েছে, ‘কবচ’ শুধু সতর্কই করে না। এই প্রযুক্তি স্বয়ংক্রিয় ভাবে ট্রেনের গতিবেগ কমিয়ে দেয় এবং এর ফলে চালকের হস্তক্ষেপ ছাড়াই ট্রেনের ব্রেক কার্যকর হয়। এই পদ্ধতির আর একটি সুবিধা হল, নেটওয়ার্ক পদ্ধতিতে ট্রেন চলাচলের গতিবিধির উপর সরাসরি নজর রাখা যায়।

    ২০২২ সালের মার্চ মাসে ‘কবচ’ ট্রেনকে দুর্ঘটনা থেকে বাঁচাতে পারে কি না, তার পরীক্ষা চলছিল। সেই পরীক্ষামূলক যাত্রায় একটি ট্রেনে ছিলেন স্বয়ং রেলমন্ত্রী। দু’টি লোকো একই লাইনে পরস্পরের দিকে ছুটে যায়। কিন্তু তাদের রক্ষা করেছিল ‘কবচ’। ধাক্কা লাগার আগেই একটি ইঞ্জিন অন্যটির থেকে ৩৮০ মিটার দূরত্বে থেমে গিয়েছিল। কোনও দুর্ঘটনা ঘটেনি। তার ভিডিয়ো টুইটারে পোস্ট করেন রেলমন্ত্রী বৈষ্ণব। জানান, পরীক্ষা ১০০ শতাংশ সফল।

    প্রশ্ন উঠছে, বন্দে ভারতের মতো দ্রুত গতির ট্রেনে যখন এত খরচ করছে রেল, তখন এই কবচ ব্যবস্থা কেন দ্রুত বসানো হচ্ছে না লাইনে? কবচ বসালে কি এড়ানো যাবে দুর্ঘটনা? রয়েছে সেই প্রশ্নও। এই দুর্ঘটনার জন্য শুধু কি কবচ না থাকাই দায়ী? রয়েছে সেই প্রশ্নও।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)