রাজবংশী উত্তরীয় পরিয়ে, হাতে গুয়াপান দিয়ে নিজের ‘প্রাসাদে’ মুখ্যমন্ত্রীকে স্বাগত বিজেপির অনন্তের
আনন্দবাজার | ১৮ জুন ২০২৪
মদনমোহন মন্দিরে পুজো দিয়েই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কনভয় ছোটে চকচকার দিকে। সেখানেই বিজেপির রাজ্যসভার সাংসদ নগেন্দ্র রায়ের বাড়ি। এলাকায় নগেন্দ্রের পরিচিতি অনন্ত মহারাজ নামে। তাঁর বাড়িকে স্থানীয়েরা ‘প্রাসাদ’ বলতে অভ্যস্ত। মুখ্যমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য অনন্ত অপেক্ষা করছিলেন বাড়ির বাইরে। মমতা সেখানে এসে পৌঁছতেই অনন্ত ছুটে এসে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। গলায় পরিয়ে দেন রাজবংশী উত্তরীয়। হাতে তুলে দেন রাজবংশী ঐতিহ্যবাহী গুয়াপান।
কোচবিহার লোকসভা কেন্দ্রটিকে পাখির চোখ করে ঝাঁপিয়েছিল তৃণমূল। কিন্তু শুরু থেকে লড়াই ছিল অত্যন্ত কঠিন। কোচবিহার লোকসভায় নির্ণায়ক রাজবংশী ভোটের একটি অংশ তৃণমূলের সঙ্গে থাকলেও অপর গোষ্ঠীর নেতা অনন্ত মহারাজ ছিলেন খোলাখুলি ভাবে বিজেপির সঙ্গে। তাঁকে সাংসদ করে রাজ্যসভায়ও পাঠায় বিজেপি। কিন্তু বিজেপির সঙ্গে অনন্তের সম্পর্ক সব সময় মসৃণ গতিতে এগোয়নি। বিভিন্ন কারণে দলীয় শীর্ষ নেতৃত্বের উপর ‘গোসা’ হয় অনন্তের। কোচবিহারের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল মহল মনে করছে, এই ‘গোসা’রই ফয়দা গিয়েছে তৃণমূলের ভোটবাক্সে। আরও বিভিন্ন সমীকরণও তৃণমূলের পক্ষে যায়। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে কোচবিহার আসনটি দখল করে তৃণমূল। ভোটের ফলের বিশ্লেষণে দেখা যায়, তৃণমূলের পক্ষে থাকা বংশীবদন বর্মণের হাতে থাকা রাজবংশী ভোট তৃণমূলে গিয়েছে তো বটেই, এমনকি অনন্তের তরফের ভোটেও থাবা বসিয়েছে তৃণমূল। এই প্রেক্ষিতে এ বার অনন্তের বাড়িতে পৌঁছে গেলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। বেশ কিছু ক্ষণ সময় চকচকার প্রাসাদে কাটান মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রী বেরিয়ে যাওয়ার পর সাংবাদিকদের অনন্ত জানান, কেবলমাত্র ‘গ্রিন টি’ খেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। দু’জনের মধ্যে হয়েছে গল্পগুজব। রাজনীতির কোনও প্রসঙ্গই সেখানে ওঠেনি বলে দাবি বিজেপি সাংসদের। অনন্তের সঙ্গে তাঁর বাড়িতে ঢোকার সময় বাড়ির বহর দেখে অবাক হন মুখ্যমন্ত্রী। হাসতে হাসতে তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘‘আমি জীবনে এত বড় বাড়ি দেখিনি।’’
প্রসঙ্গত, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বীর চিলা রায়ের নামাঙ্কিত একটি অনুষ্ঠানে এক মঞ্চে দেখা গিয়েছিল রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা এবং অনন্তকে। কিন্তু তার পরবর্তী কালে অনন্তকে বৈঠক করতে দেখা গিয়েছিল তৎকালীন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী তথা কোচবিহারের প্রাক্তন সাংসদ নিশীথ প্রামাণিকের সঙ্গে। বস্তুত, সকালে যে মঞ্চে অনন্ত মমতাকে নিয়ে এসেছিলেন, সন্ধ্যায় সেই মঞ্চেই বক্তৃতা করতে দেখা গিয়েছিল নিশীথকে। তৃণমূল নেতৃত্ব সেই ঘটনাকে ভাল ভাবে নেননি। পরবর্তী কালে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব অনন্তকে রাজ্যসভায় পাঠানোর প্রস্তাব দেন। শুরুতে আপত্তি করলেও, পরে প্রস্তাব মেনে নেন অনন্ত। শোনা যায়, অনন্তকে রাজি করানোর পিছনে ‘বড় হাত’ ছিল নিশীথের। কিন্তু নিশীথ বা তাঁর তৎকালীন ‘বস’ অমিত শাহের সঙ্গে অনন্তের সম্পর্ক মসৃণ গতিতে এগোয়নি। বিভিন্ন কারণে, দু’তরফের মনোমালিন্যের জেরে অনন্ত কার্যত ঘরে বসে যান। এই পর্বের সবচেয়ে বড় ধাক্কা ছিল ধূপগুড়ি উপনির্বাচন। যে উপভোটে বিজেপির রাজবংশী ভোট-ভান্ডারে কার্যত ধস নামিয়ে দেয় তৃণমূল। অনন্তকে প্রচারে নামিয়েও জেতা আসন ধূপগুড়ি ধরে রাখতে পারেনি বিজেপি। এর পর থেকেই ক্রমশ বদলাতে থাকে রাজার শহর কোচবিহারের চালচিত্র। বিজেপির সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে মহারাজের, ক্রমশ কাছে আসতে থাকেন তৃণমূলের কতিপয় নেতা। মঙ্গলবার বেলায় চকচকায় অনন্তের বাড়িতে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর পদার্পণ সেই ধারণাকেই আরও পোক্ত করল বলে মনে করা হচ্ছে।