মানসিক নির্যাতনের শিকার চালকরা! বিস্ফোরক ‘অভিশপ্ত’ মালগাড়ির সহকারী চালকের স্ত্রী
প্রতিদিন | ২০ জুন ২০২৪
স্টাফ রিপোর্টার, কলকাতা ও শিলিগুড়ি: জ্ঞান ফিরলেও চোখের সামনে দুই ট্রেনের সংঘর্ষে ভয়াবহ দুর্ঘটনার আতঙ্ক এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি তিনি। শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল হলেও মানসিকভাবে এতটাই বিধ্বস্ত যে, মাঝে মাঝে ফের জ্ঞানও হারিয়ে ফেলছেন কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের পিছনে ধাক্কা মারা মালগাড়ির সহকারী চালক মন্নু কুমার। একথা জানিয়েছেন মন্নুর স্ত্রী কিরণকুমারী।
তাঁর কথায়, “ভয়ংকর আতঙ্কিত হয়ে আছে, ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হচ্ছে। শরীরের কোথাও ব্যথা হলে হাত দিয়ে দেখিয়ে যন্ত্রণায় ডুকরে কেঁদে উঠছে। ঘুমের মধ্যেই কেঁপে কেঁপে উঠছে মন্নু।” বুধবার স্বামীর শারীরিক অসুস্থতার কথা শিলিগুড়ির মেয়র গৌতম দেবকে বলতে গিয়ে রেলের ঊর্ধ্বতন অফিসারদের একাংশের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক ও চাঞ্চল্যকর অভিযোগ করেছেন মন্নু-পত্নী। রেলকর্মীদের সঙ্গে অফিসারদের একাংশের অমানবিক ব্যবহারের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে কিরণকুমারী বলেছেন, “দীর্ঘদিন রেলে নিয়োগ না হওয়ায় চালক ও সহকারী চালকের সংখ্যা রুটে চলা ট্রেনের তুলনায় অনেকটাই কম। তাই চালক ও সহকারী চালকদের উপর দিনের পর দিন ভয়ংকর মানসিক নির্যাতন চালাচ্ছেন রেলের অফিসারদের একটা বড় অংশ। দিনের পর দিন না ঘুমিয়ে, বিশ্রাম না নিয়ে টানা ৭০-৭২ ঘণ্টা চালকদের ডিউটি করতে বাধ্য করছেন ওই রেল অফিসাররা।’’
উত্তরবঙ্গের রাঙাপানি স্টেশন পেরিয়ে ফাঁসিদেওয়ায় শিয়ালদহমুখী কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের সঙ্গে ধাক্কায় মালগাড়ির দুই চালকই মারা গিয়েছেন বলে প্রথমে জানিয়েছিল রেলবোর্ড। মঙ্গলবার জানা যায়, মালগাড়ির সহকারী চালক মন্নু কুমার মৃত নন, তিনি গুরুতর জখম হয়ে কার্যত সংজ্ঞাহীন অবস্থায় শিলিগুড়ির এক নার্সিংহোমে ভর্তি। নার্সিংহোমে শুয়ে থাকা অবস্থায় মন্নুর একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে রেলের এক কর্মী তাঁর সম্পর্কে তথ্য জানতে চাইছেন। মন্নু তাঁর কাছে পালটা প্রশ্ন করেন, মালগাড়ির চালকের কী অবস্থা? বুধবার বেলায় ওই নার্সিংহোমে মন্নুকে দেখতে যান শিলিগুড়ির মেয়র। কথা বলেন নার্সিংহোমের চিকিৎসকদের সঙ্গে। আইসিইউতে থাকা মন্নু তখন ঘুমিয়ে ছিলেন। তাই কথা বলতে পারেননি মেয়র। পরে শিলিগুড়ির সূর্য সেন কলোনির বাড়িতে পৌঁছে তাঁর স্ত্রী কিরণকুমারীর সঙ্গে মন্নুর চিকিৎসা নিয়ে কথা বলেন মেয়র। দেখা করেন জখম সহকারী চালকের বাবা রঘুনন্দন চৌধুরি ও মা দ্রৌপদী কুমারীর সঙ্গে। মন্নুরা আদতে প্রয়াগরাজের বাসিন্দা হলেও গত দুবছরের বেশি সময় হল শিলিগুড়ি শহরের ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের সূর্য সেন কলোনিতে ভাড়া থাকেন। একমাত্র ছেলের দুর্ঘটনার, খবর পেয়েই এদিনই ছুটে এসেছেন বাবা-মা।
অমানবিক রেলের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে তিনি বলেন, “ট্রেনের চালক ও সহকারী চালকদের তো কোনও ছুটিছাটা নেই। শরীর খারাপ থাকলেও তাই নিয়েও ডিউটিতে যেতে হয়। টানা দুদিন ডিউটি করে রাতে ঘরে এসে ঘুমালে মাঝরাতে ফোন করে অফিসাররা কুৎসিত শব্দ প্রয়োগ করে চালকদের বলেন,‘কেয়া, আভি রোমান্স কর রাহা হ্যায়? তুরন্ত ডিউটি মে চলা আও’। চালকদের মানুষ মনে করছেন না অফিসাররা।” নার্সিংহোমের চিকিৎসকরা এদিন স্পষ্ট জানিয়েছেন, “এরকম ভয়াবহ দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফেরার ঘটনা বিরল। চোখের সামনে দুটো ট্রেনকে সংঘর্ষ হতে দেখেছে। তাই দুর্ঘটনার ঘোর ও আতঙ্ক এখনও কাটেনি সহকারী চালকের। স্বাভাবিক হতে আরও একটু সময় লাগবে।’’ তবে ঘুমের মধ্যেই চরম আতঙ্কগ্রস্ত এই সহকারী চালক দু-একবার জানতে চাইছেন, চালক কোথায়? পরে শিলিগুড়ির মেয়র কেন্দ্রীয় সরকার ও বিজেপিকে তীব্র কটাক্ষ করে বলেন, ‘‘রেল যে কত বড় অমানবিক তা বোঝাই যাচ্ছে। কারণ একজন জীবিত মানুষকে তারা মৃত বানিয়ে দিয়েছে। কেন্দ্রে একটা দায়িত্বজ্ঞানহীন সরকার চলছে। তাই নিরীহ মানুষকে মরতে হচ্ছে। মন্নুর পরিবারের সঙ্গেও কথা হয়েছে। তাদের পাশে আমরা রয়েছি। সবরকম সহযোগিতা করা হবে তাদের।’’
দুর্ঘটনার তদন্তে নামা রেলের সেফটি কমিশনার থেকে বিশেষজ্ঞরা চাইছেন, যাঁর চোখের সামনে সেদিন মালগাড়ি গিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘায় ধাক্কা মারল সেই মন্নু কুমারের কাছ থেকে প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান জানতে। কিন্তু নার্সিংহোমের চিকিৎসকরা এদিন স্পষ্ট জানিয়েছেন. ভয়ংকর আতঙ্কগ্রস্ত মন্নু কুমার সুস্থ ও স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত জেরা দূরের কথা ওই দুর্ঘটনা নিয়ে কোনও কথা বলা যাবে না। অন্যদিকে উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের মুখ্য সুরক্ষা কমিশনার জনককুমার গর্গের নেতৃত্বে থাকা ‘সিট’ এদিন থেকেই কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে। নার্সিংহোমে চিকিৎসাধীন মালগাড়ির সহ-চালক মন্নু কুমারের সঙ্গে দেখা করতে যায় সিট। সেখানে কী কথা হয়েছে তা সংবাদমাধ্যমকে বলেননি সিটের কর্তারা। পরে শিলিগুড়ি এনজেপি সংলগ্ন এডিআরএম অফিসে বসেন তদন্তকারী কমিটির সদস্যরা। ডেকে পাঠানো হয় রাঙাপানির স্টেশন ম্যানেজার, মালগাড়ির ম্যানেজার (গার্ড), রাঙাপানি রেল গেটের গার্ড, কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের চালকদের বয়ান নথিভুক্ত হয়।