যদিও ওই বৈঠকের আলোচনা নিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে মুখ্যমন্ত্রী কিছু বলেননি। বৈঠকে যাঁরা যোগ দিয়েছিলেন, তাঁরাও মুখ খোলেননি। ফলে সরকারি ভাবে এর কোনও সমর্থন মেলেনি। কিন্তু প্রশাসনে যে ‘নাড়াচাড়া’ পড়েছে, নবান্নের একাধিক সূত্র তা জানিয়েছে।
উল্লেখ্য, ভূমি ও ভূমিসংস্কার দফতর রয়েছে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর হাতেই। কয়েক মাস আগে একাধিক জেলার প্রশাসনিক সভাতেও ভূমি দফতরের কাজ নিয়ে উষ্মাপ্রকাশ করেছিলেন মমতা। প্রশাসনিক বৈঠকের মঞ্চ থেকে মমতার এ-ও অভিযোগ ছিল, নিচুতলার কিছু সরকারি কর্মীও এ সবের সঙ্গে যুক্ত। ‘ঘুঘুর বাসা’ ভাঙার নির্দেশ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। নবান্ন সূত্রের খবর, সম্প্রতি জেলাভিত্তিক রিপোর্ট জমা পড়েছে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। নবান্নের এক কর্তার বক্তব্য, ‘‘জেলায় প্রশাসনিক বৈঠকে ম্যাডাম যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তা বাস্তবায়িত হয়নি। বদলায়নি পরিস্থিতিও। সে কারণেই তিনি ক্ষুব্ধ।’’ প্রশাসনিক সূত্রের বক্তব্য, কলকাতা শহরেও সরকারি জমি বেহাত হচ্ছে বলে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে খবর রয়েছে। সেই প্রসঙ্গ তুলে কলকাতার পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলকেও মুখ্যমন্ত্রী খানিক তিরস্কার করেছেন বলেই প্রশাসনিক সূত্রের দাবি।
নবান্ন সূত্রে এ-ও জানা গিয়েছে, ফিরহাদ হাকিমের হাতে থাকা পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের কাজ নিয়েও মুখ্যমন্ত্রী বৃহস্পতিবারের বৈঠকে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। যার মূল বিষয় হল পুর পরিষেবা। ঘটনাচক্রে, সদ্যসমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে দেখা গিয়েছে, শহরে তৃণমূলের জনসমর্থন কমেছে। যা দলের জন্য ‘উদ্বেগজনক’ বলেই মনে করছেন প্রথম সারির নেতারা। কলকাতা পুরসভা এলাকাতেই ৪৭টি ওয়ার্ডে পিছিয়ে রয়েছে তৃণমূল। বিধাননগর, আসানসোল, শিলিগুড়ির মতো ‘কর্পোরেশন’ এলাকাতেও বিজেপি আধিপত্য দেখিয়েছে। অনেকের মতে, পুর ও নগরোন্নয়ন দফতরের কাজ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ‘অসন্তোষের’ নেপথ্যে রয়েছে লোকসভায় শহুরে এলাকার ফলাফল। শুধু পুরনিগম নয়। জেলায় জেলায় মফস্সল শহরগুলিতেও তৃণমূল পিছিয়ে রয়েছে। রাজ্যের মোট ১২১টি পুরসভার মধ্যে ৬৯টিতে এগিয়ে রয়েছে বিজেপি, দু’টিতে এগিয়ে কংগ্রেস। হাওড়ার মতো পুরনিগম এলাকায় তৃণমূল জিতলেও সেখানে পরিষেবা নিয়ে নাগরিকদের ক্ষোভ রয়েছে। হাওড়া পুরসভায় প্রায় পাঁচ বছর ভোট হয়নি। সেখানে পুরসভার কাজ পরিচালনা করছে প্রশাসকমণ্ডলী। নবান্ন সূত্রে জানা গিয়েছে, আগামী সোমবার সমস্ত পুরসভার চেয়ারম্যানদের নিয়ে বৈঠক ডেকেছেন মুখ্যমন্ত্রী। চেয়ারম্যানদের পাশাপাশি ডাকা হয়েছে পুরসভার শীর্ষ আধিকারিকদেরও।
নবান্ন সূত্রের খবর, বিদ্যুৎ দফতরের কাজ নিয়েও মুখ্যমন্ত্রী খুশি নন। যে দফতরের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। নবান্নের এক কর্তার কথায়, ‘‘সরকারের বিভিন্ন দফতর খালি হয়ে যাওয়ার পরেও সেখানে আলো জ্বলে, পাখা চলে। কোথাও কোথাও বন্ধ করা হয় না বাতানকূল যন্ত্রও। এর ফলে বিদ্যুতের যেমন অপচয় হচ্ছে, তেমনই সরকারের টাকা অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে। তা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী।’’
তবে বৃহস্পতিবারের বৈঠকে মমতার ‘মূল নিশানা’ ছিল ভূমি দফতরের কাজ। দীর্ঘ দিন ধরে বলে বলেও কেন সরকারি নির্দেশ কার্যকর হচ্ছে না, জমি বেহাত হয়ে যাচ্ছে, জেলাশাসকেরা কেন ‘মনিটরিং’ করছেন না, সেই প্রশ্ন তুলে প্রশাসনকে কড়া বার্তা দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। ঘটনাপ্রবাহ বলছে, লোকসভা ভোট মিটতেই প্রশাসনিক কাজে গতিবৃদ্ধি করতে চাইছেন মুখ্যমন্ত্রী। এর আগে গোটা মন্ত্রিসভা, সমস্ত দফতরের সচিব, জেলাশাসক, পুলিশকর্তাদের নিয়ে বৈঠক করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তার পরে বণিকমহলের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও বিনিয়োগ নিয়ে বৈঠক করেছেন মমতা। সেখানেও তিনি শিল্পপতিদের বলেছেন, কোনও রকম ‘অসুবিধা’ হলে তা সরকারকে সরাসরি জানাতে। অনেকের মতে, ভোটের মধ্যে সে ভাবে প্রশাসনিক কাজ করা যায়নি। ভোট মিটতেই সেই ‘জড়তা’ কাটাতে চাইছেন মুখ্যমন্ত্রী।