কবে মিলবে সেই জীবনদায়ী ইনজেকশন? সদুত্তর নেই ইএসআই-কর্তৃপক্ষের কাছেও। বরং, ‘ফ্যাক্টর-৮’ সরবরাহকারী সংস্থাকে বার বার বলার পরেও সেই ইনজেকশন মিলছে না বলেই দাবি কর্তৃপক্ষের। তাঁরা জানাচ্ছেন, নতুন করে সরবরাহ না হওয়া পর্যন্ত কিছুই করার নেই! অথচ ‘ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব হিমোফিলিয়া’ (ডব্লিউএফএইচ)-র সুপারিশ রয়েছে, আক্রান্তদের সপ্তাহে অন্তত তিন বার ‘অ্যান্টি হিমোফিলিক ফ্যাক্টর’ দিলে বেশি উপকার হবে। তাতে রোগীর ‘ফ্যাক্টর লেভেল’ শূন্যে নামবে না। প্রশ্ন উঠছে, কলকাতা-সহ বিভিন্ন জেলার ইএসআই হাসপাতাল থেকে যে সব হিমোফিলিয়া আক্রান্তেরা ওই ইনজেকশন পান, তাঁদের কী হবে?
চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, কোনও আঘাত ছাড়াই হিমোফিলিয়া আক্রান্ত রোগীর শরীরের যে কোনও অংশ, বিশেষত গাঁট (জয়েন্ট) থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে। এমনকি মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে তা প্রাণঘাতীও হতে পারে। সেখানে নিয়মমাফিক ‘ফ্যাক্টর-৮’ না পাওয়ার ফলে ইতিমধ্যেই সমস্যায় পড়েছেন অনেক রোগী।
যেমন, শ্যামনগরের বাসিন্দা সুমন্ত রায় কল্যাণীর ইএসআই হাসপাতাল থেকে ইনজেকশন নিতেন। কিন্তু শেষ এক সপ্তাহ ধরে বার বার সেখানে গিয়েও ইনজেকশন আসেনি শুনে তাঁকে ফিরে আসতে হয়েছে। এক সপ্তাহ ধরে ‘ফ্যাক্টর-৮’ না পাওয়ার ফলে, ইতিমধ্যেই সুমন্তের শরীরের বিভিন্ন অস্থির সংযোগস্থলে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে। আঙুল ফুলে অসম্ভব যন্ত্রণা হচ্ছে। বেসরকারি সংস্থার ওই কর্মী বলেন, ‘‘একটা সংস্থা সরবরাহ করতে পারছে না বলে কর্তৃপক্ষ বসে থাকবেন কেন? এতে রোগীদের ভোগান্তি আরও বাড়ছে। বাইরে থেকে ৪০-৫০ হাজার টাকা খরচ করে পুরো কোর্সের ইনজেকশন কেনা সবার পক্ষে সম্ভব নয়।’’
একই রকমের সমস্যায় ভুগছেন সোদপুরের ৩২ বছরের যুবকও। কামারহাটি ইএসআই হাসপাতাল থেকে তিনি ‘ফ্যাক্টর-৮’ পেতেন। শেষ পনেরো দিন ধরে সেখানে অমিল ওই ইনজেকশন। হাঁটুর ভিতরে ক্রমাগত রক্তক্ষরণ হওয়া ওই যুবকের কথায়, ‘‘মানিকতলা, শিয়ালদহের হাসপাতাল থেকেও প্রতিদিন অনেক হিমোফিলিয়া আক্রান্ত খালি হাতে ফিরে যাচ্ছেন।’’ একই অবস্থা দক্ষিণ ২৪ পরগনা, বর্ধমান, হাওড়া-সহ অন্যান্য জেলায়। সর্বত্রই রোগী বা তাঁদের পরিজনদের প্রশ্ন, ‘‘বাজার থেকে ‘ফ্যাক্টর-৮’ কেনার মতো আর্থিক সামর্থ্য যাঁদের নেই, তাঁদের কি তা হলে বিনা চিকিৎসায় মরতে হবে?’’
জানা যাচ্ছে, কলকাতা ও বিভিন্ন জেলা মিলিয়ে রাজ্যে ইএসআই হাসপাতাল রয়েছে ১৩টি। সেগুলিতে চিকিৎসাধীন হিমোফিলিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১৩০-১৪০। তাঁদের মধ্যে ১০০-১১০ জন ‘ফ্যাক্টর-৮’ পান (বাকিরা ‘ফ্যাক্টর-৯’ পান)। কিন্তু সপ্তাহে একটিও ‘ফ্যাক্টর-৮’ না পাওয়ার কথা স্বীকার করছেন ইএসআই-এর হিমোফিলিয়ার নোডাল অফিসার তথা শিয়ালদহ ইএসআই হাসপাতালের সুপার অদিতি দাস। তাঁর কথায়, ‘‘এএইচএফ-৮ এর বরাত দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সংস্থা সরবরাহ করতে পারছে না। তাই রোগীকে ফেরত পাঠাতে হচ্ছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও কথা বলছি।’’
অদিতি জানান, ইএসআই-এর ভাঁড়ারে ‘অন ডিমান্ড’ হিসেবে কিছু ‘ফ্যাক্টর-৮’ মজুত রাখতে হয়েছে। যাতে হিমোফিলিয়া আক্রান্ত কোনও রোগীর অস্ত্রোপচার কিংবা দুর্ঘটনার চিকিৎসায় ব্যবহার করা যায়। তিনি আরও বলেন, ‘‘নিয়মিত ইনজেকশন না পেয়ে যাঁদের রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে, জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে নিয়ে এলে তাঁদের জন্য কিছু ‘ফ্যাক্টর-৮’ মজুত রাখা হয়েছে।’’
সমস্যাটি গুরুতর বলেই মত হেমাটোলজিস্ট প্রান্তর চক্রবর্তীর। তাঁর কথায়, ‘‘রক্তক্ষরণ কম হওয়া, অস্থিসন্ধির ক্ষতি না হওয়া এবং প্রাণঘাতী রক্তক্ষরণ আটকাতে এই ইনজেকশন। আক্রান্ত যাতে নিয়মিত সেটি পান, তার জন্য পর্যাপ্ত ইনজেকশন মজুত করা প্রয়োজন।’’ তিনি বলেন, ‘‘অন ডিমান্ড’-এ ইনজেকশন দিয়ে প্রাণ বাঁচানো গেলেও, অস্থিসন্ধির ক্ষতি পুরোপুরি আটকানো যায় না।”