• গানের সুরে কমবে রোগের যন্ত্রনা, কাটবে ক্লান্তি-অবসাদ
    আজকাল | ২১ জুন ২০২৪
  • লোপামুদ্রা ভৌমিক: চেষ্টাটা চলছিল ১৯৮১ থেকেই। ফ্রান্সের সেই সময়কার সংস্কৃতিমন্ত্রী জ্যাক লাঙ চেয়েছিলেন শুধুমাত্র সঙ্গীতের জন্য একটা দিন হোক। যে দিনে মহাবিশ্বের প্রতিটি প্রান্ত একসঙ্গে বাঁধা পড়বে গানের সুরে। মহাকাশের বাধাহীন বাতাস ওই দিনটাতে হয়ে উঠবে শুধুমাত্র সুরের–সারথি। সেই ভাবনা থেকেই ১৯৮২–তে ফ্রান্সে শুরু হল ‘‌ফেট ডে লা মিউজক’‌। যার অর্থ বিশ্ব জুড়ে সঙ্গীতের দিন। আসলে সুরই তো সুস্থতার অন্যতম মন্ত্র। বিশ্বায়নের বিশ্বে হাজারো জটিলতায় যখন জীবন নাজেহাল, বিজ্ঞানীরা বলছেন দিনশেষে বা সাময়িক অবসরে নিজেকে সঁপে দিন সুরের হাতে। দেখবেন এক নিমেষে নিজেকে কেমন ফুরফুরে লাগছে। ক্লান্তি ধুয়েমুছে সাফ করে দেওয়ার আশ্চর্য টোটকা আছে সুরের ঘরে। এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, কেমন সুর?‌ কেমন ধারার গান শুনলে সুস্থতা চটজলদি এসে ধরা দেবে নাগালে?‌ বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারে একেবারে দিলদরিয়া। জানিয়ে দিয়েছেন, ঠিক যে ধরনের গান বা সুর আপনি পছন্দ করেন সেটাই শুনুন। মূল উদ্দেশ্য হল শোনা। সারাদিন কানে হেডফোন লাগিয়ে একটা শব্দ নাগাড়ে মস্তিষ্কে চালান করে যাওয়া বা বিকট শব্দে এলাকা কাঁপিয়ে নিজেকে ‘‌সঙ্গীতপিপাসু’‌ প্রমাণ করার কোনও দরকার নেই। সুস্থ থাকতে সুস্থভাবে সুরে ডুব দিন। তবেই না যত ব্যধির বালাই, বলবে পালাই পালাই!‌ 

    সুর দিয়ে রোগমুক্তি এবং যন্ত্রণামুক্তির বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা চালাচ্ছেন অস্থিশল্যবিদ ডাঃ সুমন্ত ঠাকুর। বাগুইআটিতে তাঁর নার্সিংহোমে তৈরি করেছেন নিজস্ব মিউজিক থেরাপি ইউনিট। তাঁর দাবি, যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, এমন রোগীকে বা অপারেশন–পরবর্তী ব্যথায় কাতর মানুষকে যদি ঠিকঠাকভাবে সঙ্গীত–চিকিৎসা দেওয়া যায়, তাহলে কাজ হয় মন্ত্রের মতো। শুধু তাই নয়, অস্ত্রোপচার চলাকালীনও তিনি রোগীকে সুর–দাওয়াই দিয়ে উদ্বেগমুক্ত রাখতে পারছেন। এমনও হচ্ছে, অপারেশন চলাকালীন রোগী নিজে ছোটখাটো কোনও বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছেন!‌ গান গাইছেন!‌ তাঁর মতে, অপারেশনের পর মিউজিক কাউন্সেলিং ম্যাজিকের মতো কাজ দিচ্ছে। এর ফলে মানসিক প্রশান্তি আসে, মনমেজাজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে গানের জুড়ি মেলা ভার। এর আসল কারণটা অবশ্য লুকিয়ে রয়েছে শরীরবিজ্ঞানের জটিল আবর্তে। ভাললাগা গানের সুর কানের মধ্যে দিয়ে মস্তিষ্কে গিয়ে ধাক্কা দিলে সেখান থেকে প্রোল্যাক্টিন হরমোনের নিঃসরণ বেড়ে যায়। এই হরমোনের সঙ্গে মানসিক সুস্থতা দুধেজলে মিশে রয়েছে। এই হরমোনের অধিক নিঃসরণ উদ্বেগ দূর করে, যন্ত্রণা কমায়, মনকে ইতিবাচক করে তোলে। তাছাড়া সুর বা বাদ্যযন্ত্র মস্তিষ্কের প্রত্যেকটা প্রত্যঙ্গকে উদ্দীপিত করে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত রোগীরা সবার শেষে যেটি ভুলে যায়, তা হল গান। চিকিৎসক, মনোবিজ্ঞানী, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, সঙ্গীত গবেষকদের নিয়ে এজন্য একটি দলও গড়ে তুলেছেন সুমন্ত। যার তত্ত্বাবধানে আছেন প্রিয়দর্শিনী দাশগুপ্ত। 

    নয়ের দশক থেকে সুর–থেরাপি নিয়ে কাজ করছেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ তথা সঙ্গীতশিল্পী রাজ্যশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়। বললেন, এই পদ্ধতি বহু প্রাচীন। ইদানীং অনেকেই রোগীকে সুস্থ করে তুলতে মিউজিক থেরাপি ব্যবহার করেন। মিউজিকের নিজস্ব কিছু উপাদান রয়েছে। যেমন, গানের কথা, শব্দের মাত্রা, ছন্দ, লয় ইত্যাদি। একেক জনের স্নায়ুর ওপর এর প্রভাব পড়ে একেক রকম। চিকিৎসাটা করতে হবে সেভাবেই। যে কোনও একটা গান বাজিয়ে শুনিয়ে দিলাম আর রোগমুক্ত হয়ে গেল, বিষয়টা সেরকম নয়। এটা একটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এদেশে খুব কম জায়গাতেই এখনও পর্যন্ত এতটা নিপুণভাবে সুর–চিকিৎসা হয়।
  • Link to this news (আজকাল)