১৬৫ বছর আগে যে বাংলার বুকে জ্বলেছিল নীল বিদ্রোহের আগুন, সেই বাংলাতেই আবার নতুন করে শুরু হলো নীল চাষ! পুরুলিয়ার মানবাজার ১ নম্বর ব্লকে এই বছর থেকে বাণিজ্যিক ভাবে নীল চাষ শুরু করেছে ‘মহাত্মা গান্ধী গ্রামোদ্যোগ সেবা সংস্থান ফাউন্ডেশন’ নামে একটি সংস্থা। প্রথম ধাপে ৮০ বিঘা জমিতে নীল চাষ শুরু হয়েছে। আপাতত মোট ২২ জন স্থানীয় কৃষক এই প্রকল্পে যুক্ত।প্রত্যেকেই আদিবাসী। তাঁদের প্রযুক্তিগত সাহায্য করছে কুমায়ুনের ‘অবনি সোসাইটি’। এ জন্য সিএসআর ফান্ড থেকে অর্থ বিনিয়োগ করেছে বেঙ্গালুরুর একটি বহুজাতিক ঘড়ি প্রস্তুতকারক সংস্থা। ১৭৭৭ সালে ফরাসি বণিক লুই বোনো ভারতে প্রথম নীল চাষের সূচনা করেন। সে সময়ে শিল্পবিপ্লবের ফলে ইংল্যান্ডে বস্ত্রশিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল। কাপড় রং করতে ইংল্যান্ডে নীলের বিপুল চাহিদা তৈরি হয়। তার অন্যতম জোগানদাতা ছিলেন বাংলার নীল চাষিরা।
১৮৩৩ সালে ব্রিটেনের পার্লামেন্টে পাশ হওয়া নতুন আইনের জোরে ব্রিটেনের যে কোনও নাগরিক ভারতে এসে নীল চাষের অধিকার পান। বাংলায় বাড়তে থাকে নীলকুঠির সংখ্যা। প্রথমে সাহেবেরা দেশীয় প্রজাদের থেকে জমি কিনে বা ভাড়া নিয়ে নীলচাষ করতেন। এ জন্য চাষিদের দাদন দেওয়া হতো। দাদনের শর্ত পূরণ করতে না-পারলেই চলত অকথ্য অত্যাচার। তার বিরুদ্ধে ১৮৫৯ সালে গর্জে ওঠে বাংলার কৃষক সমাজ।
ইতিহাসে যা ‘নীল বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত (যদিও তার বেশ কিছু বছর আগে থেকেই নীলকরদের বিরুদ্ধে গর্জন শোনা গিয়েছিল বাংলায়। সাহেবদের ত্রাস হয়ে ওঠেন ‘বিশে ডাকাত’, গ্রাফিক্স দেখুন)। হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘দ্য হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকা, দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীল দর্পণ’ নাটক সে বিদ্রোহের দলিল। ‘নীল দর্পণ’-এর ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। রেভারেন্ড জেমস লং সেটি প্রকাশ করেন।
ক্রমে নীল চাষ নিয়ে ইংল্যান্ডেও বিতর্কের ঝড় ওঠে। ভারতে বিদ্রোহ থামাতে ১৮৬০ সালে গঠিত হয় পাঁচ সদস্যের ‘ইন্ডিগো কমিশন’। তারা চাষিদের অভিযোগে মান্যতা দেয়। কমিশনের প্রস্তাব মেনে বাড়িয়ে দেওয়া হয় নীল গাছের দাম। বাতিল করা হয় সমস্ত দমনমূলক নীল-আইন। চালু হয় ‘তিন কাঠিয়া’ ব্যবস্থা। ঠিক হয়, বিঘা প্রতি তিন কাঠা জমি নীল চাষের জন্য বরাদ্দ থাকবে। বাকি অংশে চাষিরা তাঁদের ইচ্ছামতো ফসল ফলাতে পারবেন। অতঃপর ধীরে ধীরে পাততাড়ি গোটাতে শুরু করেন নীলকরেরা।
১৮৬২ সালে ভারতে বলবৎ হয় ‘ইন্ডিগো অ্যাক্ট’। ১৮৬৮ সালে নীল চাষ সম্পূর্ণ চাষিদের ইচ্ছাধীন করা হয়। ১৮৯২ সালে রাসায়নিক পদ্ধতিতে নীলের উৎপাদন শুরু হওয়ার পরে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় নীল চাষ। এত দিন বাদে আবার হঠাৎ করে বাংলায় নীল চাষের প্রয়োজন পড়ল কেন? ‘মহাত্মা গান্ধী গ্রামোদ্যোগ সেবা সংস্থান ফাউন্ডেশন’-এর অন্যতম কর্মকর্তা অরূপ রক্ষিত জানাচ্ছেন, বাজারে রাসায়নিক রংয়ের অভাব না-থাকলেও বিশ্ববাজারে অর্গ্যানিক নীলের চাহিদা বাড়ছে। যা ব্যবহার হয় মূলত পিওর কটনে।
এই নীল প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি হয় বলে তার থেকে স্কিনে কোনও রিঅ্যাকশন হয় না। বাইরের তাপ থেকে শরীরকে কিছুটা রক্ষাও করে। বিদেশি কোম্পানিগুলি জিন্সের সুতো রং করার জন্য ন্যাচরাল ইন্ডিগোকেই বেছে নিচ্ছে। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্ডিগো কোম্পানি’। তামিলনাড়ু-সহ দক্ষিণ ভারতের কিছু রাজ্যে বেশ কয়েক বছর ধরেই নীল চাষ করছেন সেখানকার কৃষকরা। বহু সংস্থা চাষিদের থেকে সরাসরি নীল গাছের পাতা কিনে নেয়। যার বর্তমান বাজার দর কিলো প্রতি ১০-১৫ টাকা।
চা-গাছের মতো বছরে অন্তত তিন বার নীল গাছের পাতা কেটে নিতে হয়। এক হেক্টর জমি থেকে একেক দফায় গড়ে ৬ টন করে পাতা সংগ্রহ হয়। অর্থাৎ বছরে গড়ে ১৮ টন পাতা ওঠে। চাষের সমস্ত খরচ-খরচা বাদ দিয়ে হেক্টর পিছু বছরে গড়ে এক থেকে দেড় লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয় হয় চাষির। যেটা ধান, পাট, আলুতে সম্ভব নয়।
একটা সময় পর্যন্ত ধারণা ছিল, নীল চাষ করলে জমির উর্বরতা কমে যায়। নীল বিদ্রোহের নেপথ্যে এটাকে অন্যতম বড় কারণ বলে মনে করা হয়। অবনি সোসাইটির অন্যতম কর্মকর্তা তথা এই প্রকল্পের মুখ্য কনসালট্যান্ট শুভম শ্রীবাস্তব অবশ্য সেই সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দিয়েছেন— ‘নীল চাষ বেড়ে যাওয়ায় বাংলায় তখন খাদ্যসঙ্কট দেখা দিয়েছিল। সে জন্য হয়তো এ রকম একটা নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছিল।’
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জ়ুলজি বিভাগের অধ্যাপক কৃষ্ণেন্দু আচার্য বলেন, ‘নীল গাছ লেগুমিনাস জাতীয় উদ্ভিদ। এর শিকড়ে নাইট্রোজেন আবদ্ধকারী রাইজ়োবিয়াম ব্যাকটেরিয়া থাকে। যা জমির স্বাস্থ্য ফেরাতে সাহায্য করে।’ মানবাজার ১ নম্বর ব্লকের মহন্ডি গ্রামের বাসিন্দা সাবিত্রী মাহাতো বলেন, ‘আমি প্রথমবার নীল চাষ করছি। আগে টুকটাক সব্জি করতাম। যদি দেখি এতে ভালো লাভ হচ্ছে তা হলে ভবিষ্যতে এটাই করব।’
আর এক চাষি বাপি সোরেন বলেন, ‘আমাদের এখানে কোনও কাজকর্ম নেই। বাধ্য হয়ে বাইরে যেতে হয়। এ বছর থেকে নীল চাষ শুরু করেছি। ওঁরা আমাদের সবরকম সাহায্য করছেন। আমাদের খুব একটা টাকা খরচ করতে হচ্ছে না।’