বিশ্বজ্যোতি ভট্টাচার্য, শিলিগুড়ি: আষাঢ়ের শুরুতে পাকা কাঁঠালের সুবাসে পাগল হাতির দল লোকালয়ে পা বাড়াতে আতঙ্কের ছায়া উত্তরের তরাই-ডুয়ার্সের জঙ্গল লাগোয়া এলাকায়। বেড়েই চলেছে মানুষ-হাতি সংঘর্ষ, ঘরবাড়ি, হোটেল, স্কুল ভাঙচুরের ঘটনা এবং মৃত্যু। শুক্রবার রাতে শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদের নকশালবাড়ি আশাপুর চা বাগান সংলগ্ন এলাকায় হাতির হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন এক বনকর্মী।
মৃতের নাম রাজেন্দ্র রাই (৪৮)। এদিনের ঘটনা নিয়ে জুন মাসে হাতির হামলায় অন্তত পাঁচজনের মৃত্যু হল। পরিস্থিতি মোকাবিলায় বন দপ্তরের তরফে ডুয়ার্সে মাইকে প্রচার চলছে। পাশাপাশি একটি নম্বর বিলি করা হয়েছে গ্রামবাসীদের। হাতি দেখামাত্র যেখানে ফোন করলে বনকর্মীরা পৌঁছে যাবেন। কিন্তু বনকর্মীরাও নিস্তার পাচ্ছেন কোথায়!
শুক্রবার রাতে শিলিগুড়ির নকশালবাড়ি ব্লকের কলাবাড়ি জঙ্গল সংলগ্ন এলাকার ঘটনা বনকর্মীদেরও নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। বনদপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে, নকশালবাড়ির আশাপুর চা বাগান সংলগ্ন এলাকায় একটি হাতির দল পাকা কাঁঠালের লোভে ঢোকে। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে চারজন বনকর্মী হাতির দলটিকে জঙ্গলে ফেরানোর চেষ্টা করলে বিপত্তি ঘটে। একটি হাতি খেপে বনকর্মীদের দিকে তেড়ে যায়। তিনজন কর্মী পালিয়ে বাচলেও রাজেন্দ্র রাই হাতির দলের সামনে পড়ে যান। একটি হাতি তাঁকে পিষে মারে। ঘটনায় এক বনকর্মী জখম হন। কার্শিয়াং বন বিভাগের ডিএফও দেবেশ পাণ্ডে জানান, কয়েকদিন থেকে হাতির দলটি আশাপুর চা বাগান সংলগ্ন এলাকায় ঘোরাফেরা করছে। স্থানীয় বাসিন্দা জনকলাল ছেত্রী জানান, লোকালয়ে ঢুকে গাছে পাকা কাঁঠাল না পেলেই হল। হাতিরা খেপে ভাঙচুর চালাচ্ছে। এর আগে ৮ জুন শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদের খড়িবাড়ি ব্লকের বুড়াগঞ্জ গ্রাম পঞ্চায়েতের দেওয়ানভিটা এলাকায় ঈশ্বর সিংহ নামে এক ব্যক্তিকে হাতি পিষে মারে। স্থানীয় বাসিন্দাদের সূত্রে জানা গিয়েছে, পাকা কাঁঠালের লোভে টুকরিয়াঝার জঙ্গল থেকে ওই এলাকায় প্রায় রাতে হাতি ঢুকছে। দেওয়ানভিটা এলাকার ঘটনার রেশ না কাটতে ১০ জুন ভোরে নকশালবাড়ির লোহাসিং জোতে হাতির দল ঢুকে তান্ডব চালায়। বুনোরা সেখানে লাতে আসুর নামে এক ব্যক্তিকে পিষে মারে।
তবে বনকর্মীদের সূত্রে জানা গিয়েছে, তরাই এলাকার তুলনায় বুনো হাতির তান্ডব বেশি ডুয়ার্সে। ১০ জুন রাতে হাতির দল হামলা চালিয়ে বিধ্বস্ত করে মালবাজারের নাগরাকাটার বামনডাঙা চা বাগানের টন্ডু টিজি থ্রি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ঘটনার রেশ না কাটতে ১১ জুন রাতে পাকা কাঁঠালের লোভে উত্তর সিমলাবাড়ি গ্রামে ঢুকে এক ব্যক্তিকে সামনে পেয়ে আছড়ে মারে বুনো হাতি। এর পর একটি বড় হাতির দল জলপাইগুড়ি শহরমুখী হয়। সেটা ১৪ জুন। আলিপুরদুয়ার নেচার ক্লাবের অন্যতম কর্মকর্তা অভিজিৎ মালাকার বলেন, “পাকা কাঁঠাল, চালতার গন্ধ পেলে হাতি স্থির থাকতে পারে না। প্রতি বছর কাঁঠাল পাকার মরশুমে লোকালয়ে হাতির যাতায়াত বেড়ে যায়। এবারও সেটাই হয়েছে।” মাদারিহাটের বাসিন্দা প্রদীপ সরকার জানান, গাছে কাঁঠাল থাকলে রক্ষা। নইলে তাণ্ডব চলছে। একই কারণে ১৭ জুন রাতে আলিপুরদুয়ার জেলার কুমারগ্রামের মধ্য হলদিবাড়ি গ্রামে হাতির দল ঢুকে চারটি বাড়ি ভেঙে গুড়িয়ে দেয়। শুধু বাড়ি অথবা স্কুলঘর নয়। হোটেলেও হামলা চালাচ্ছে হাতি।
রেডব্যাঙ্ক চা বাগান লাগোয়া ১৭ নম্বর জাতীয় সড়কের একটি হোটেলে চড়াও হয় হাতির দল। ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় হোটেলের একাংশ। সেটা ১৮ জুন। একই রাতে মেটেলি ব্লকের বড় দিঘি চা-বাগানের টিলাবাড়ি ডিভিশন ওজন লাইনে রীতিমতো তাণ্ডব চালায় হাতি। ভাঙে দোকান, বাইক। এলাকার লোকজন পালিয়ে বাঁচেন। এমন পরিস্থিতিতে কার্যত দিশাহারা দশা হয়েছে বনকর্মীদের। পরিস্থিতি সামাল দিতে তারা গ্রামে সচেতনতামূলক প্রচার শুরু করেছেন। জলপাইগুড়ির জেলার দক্ষিণ ধূপঝোড়া গ্রাম পঞ্চায়েত সহ বিভিন্ন গ্রামে মাইকে ওই প্রচার চলছে।