এ বছরেই পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হয়েছেন পুরুলিয়ার 'গাছদাদু' দুখু মাঝি। কিন্তু, পদ্মশ্রী না পাওয়া এমন বহু দুখু মাঝি নীরবে কাজ করে চলেছেন বিভিন্ন জেলায়। জীবনভর যাঁরা গাছ পুঁতেছেন, যত্ন নিয়ে বড় করে তুলেছেন। তাঁরাও দুখু মাঝির মতো এলাকায় 'গাছদাদু' নামে পরিচিত। তেমনই এক 'গাছদাদু' বাঁকুড়ার সারেঙ্গার বাসিন্দা অশীতিপর শ্যামাপদ বন্দ্যোপাধ্যায় এ পর্যন্ত প্রায় আট হাজার গাছ লাগিয়েছেন।
গাছের প্রতি শ্যামাপদর ভালোবাসা সেই আট বছর বয়স থেকে। শুরুটা হয়েছিল বাবার পরামর্শ মতো নিজেদের বাড়ির উঠোনে তালের আঁটি পুঁতে। তার পর সময়ের সঙ্গে বেড়েছে তাঁর গাছ লাগানোর নেশা। সরকারি জমি, স্কুল, পুকুরপাড়, রাস্তার ধারে অজস্র গাছ পুঁতেছেন। এমনকী অন্যের বাড়িতে গিয়েও গাছ পুঁতেছেন। নিঃস্বার্থ ভাবে সেই কাজ আজও করে চলেছেন এই বৃদ্ধ। শুধু গাছ লাগিয়েই হাত গুটিয়ে নেন না। গাছ বড় করতে পরিচর্যাও করেন। দক্ষিণ সারেঙ্গার কাশীবন গ্রামের বাসিন্দা শ্যামাপদ বলেন, 'ছোটবেলায় প্রথমে জেনেছিলাম, গাছে পাখিরা বাসা বাঁধে। তাদেরও সংসার হয়। জ্ঞান হতে আরও বুঝলাম গাছ অক্সিজেন দেয়, প্রাণ বাঁচায়। তাই আরও বেশি করে গাছ লাগাতে শুরু করি। এটা আমার নেশা হয়ে গিয়েছে। আমি গাছ না লাগিয়ে থাকতে পারি না। নিজের স্বার্থ ত্যাগ করে জীবনে বহু গাছ লাগিয়েছি। কমপক্ষে হাজার আটেক তো হবেই। এই গাছ জীবজগতের প্রাণ।' বছর কয়েক আগে বাঁকুড়ার এই গাছদাদুকে সম্মানিত করে জেলা প্রশাসন।
গাছের তালিকায় রয়েছে আম, জাম, কাঁঠাল, খেজুর, নারকেল, শাল, মহুয়া, বট, অশ্বত্থ। তবে শ্যামাপদ সবচেয়ে বেশি লাগিয়েছেন তালগাছ। বৃদ্ধের বড় ছেলে মনোজ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, 'বাবা ভালোবাসেন তাই গাছ লাগান। কখনও ফুল বা ফলের আশা করে গাছ পোঁতেননি। গাছের প্রতি প্রেমই বাবাকে আজও শক্ত-সমর্থ রেখেছে। বয়স হয়েছে বলে মনেই হয় না। এখনও দিব্যি স্কুটি চালিয়ে ঘোরেন। কোদাল দিয়ে মাটি কোপান। মনটাও রয়েছে তরুণের মতো।'
২০২১-এ রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য পিড়রগাড়ি মোড় থেকে সারেঙ্গা যাওয়ার পথে রাজ্য সড়কের দু'ধারে থাকা তালগাছের সারি কেটে ফেলা হয়। মাথা উঁচু করে ল্যান্ডমার্কের মতো দাঁড়িয়ে থাকা সেই সব তালগাছ বাঁচিয়ে রাখতে তখন আন্দোলন গড়ে তুলেছিল 'সারেঙ্গা গ্রিন ফোর্স'। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সেই আন্দোলনে সামিল হন শ্যামাপদ। যদিও শেষ পর্যন্ত রোখা যায়নি গাছ কাটা। সম্প্রসারণের কাজ শেষ হলে ফের ওই জায়গাতেই নতুন রাস্তার দু'ধারে দ্বিগুণ তালের আঁটি পুঁতেছেন সেদিনের আন্দোলনকারীরা। সেখানেও সকলের সঙ্গে দিনের পর দিন সেই আঁটি পোঁতার কাজে দেখা গিয়েছে শ্যামাপদকে। প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক তথা 'সারেঙ্গা গ্রিন ফোর্স'-এর সম্পাদক পার্থসারথি সুরাল বলেন, 'উনি এই বয়সেও যে ভাবে কোদাল, গাঁইতি চালিয়ে মাটি খুঁড়ে গাছ লাগান তাতে আমরা উৎসাহ পাই। উনি আমাদের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাস্যাডর।' ওই সংগঠনের সদস্য আশিস পাল বলেন, 'আমরা আশা রাখি, দৃষ্টান্তমূলক এই কাজের উপযুক্ত স্বীকৃতি উনি একদিন পাবেন।'