সত্যজিৎ রায়ের ছবি পরশপাথর। কুড়িয়ে পাওয়া পরশপাথর হাতে নিয়ে লোহার খোঁজে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তুলসী চক্রবর্তী। একটি দৃশ্যে দেখা যায় খোলা মাঠে ডাঁই করে রাখা কামানের গোলা, বাতিল লোহার বিম ও বহু ছাঁটাই লোহার বিশাল বিশাল টুকরো। চোখের সামনে তালতাল লোহা পেয়ে চোখ চকচক করে ওঠে তাঁর। তার পরেই ভাগ্য ফেরে তাঁর। বিপুল লোহা মুহূর্তে সোনা হয়ে ধস নামে সোনার দামে।ছবির ওই দৃশ্যটি অবাস্তব নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। তখন থেকেই ব্যবসায়ীদের হাত ঘুরে দেশের পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ও অন্যান্য অংশ থেকে প্রচুর যুদ্ধের বাতিল সামগ্রী বা ওয়ার ডিসপোজ়াল আসতে শুরু করে কলকাতায়। হাওড়ার ঘুসুড়ির একটি ফাঁকা মাঠে এসে তা জড়ো হতে থাকে। তথ্য অনুযায়ী, রামেশ্বরলাল আগরওয়াল নামের একজন ব্যবসায়ীই এই ব্যবসা প্রথম শুরু করেন। বাতিল পুরোনো বা স্ক্র্যাপ লোহার ব্যবসা তিনি শুরু করেন তাঁর সংস্থা বজরংবলী এন্টারপ্রাইজের নামে। ধীরে ধীরে ওই ফাঁকা মাঠ জুড়ে গড়ে ওঠে আরও অনেক এমন স্ক্র্যাপ লোহা ও অন্য ছাঁট ধাতুর বাজার। কালে কালে পুরো বাজারেরই নাম হয়ে দাঁড়ায় বজরংবলী মার্কেট।
প্রায় ১০০ বিঘারও বেশি জায়গা জুড়ে এই বাজার গড়ে উঠেছিল এখন থেকে প্রায় ৭৫-৮০ বছর আগে। শোনা যায় রামেশ্বরলাল ওই জমি গুহ পরিবারের থেকে লিজ নিয়ে ওই বাজার বসিয়েছিলেন। উত্তরে অভয় গুহ রোড থেকে দক্ষিণে গুহ রোড এবং পূর্বে গিরিশ ঘোষ রোড থেকে পশ্চিমে জিটি রোড এই সীমানার মধ্যেই এ ভাবে গড়ে উঠেছিল পুরোনো বজরংবলী মার্কেট। যুদ্ধ শেষের পর রেলের ছাঁট লোহার বড় অংশ এই বাজারে এসে পৌঁছনো শুরু হয়। বাতিল রেল ইঞ্জিন থেকে শুরু করে রেললাইন, বাতিল ওয়াগন, বগি, বাতিল জাহাজ, পুরোনো কারখানার শেড এমন হাজারো জিনিস নানা হাত ঘুরে বজরংবলীতে এসে পৌঁছতে শুরু করে। ক্রমে বজরংবলীর নাম ছড়িয়ে পড়ে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও।
এক সময় এশিয়ার বৃহত্তম স্ক্র্যাপ মার্কেট হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেছে বজরংবলী। প্রতিদিন শয়ে শয়ে কোটি টাকার লেনদেন এখানে ছিল জলভাত। এই মার্কেটের ক্ষমতার জোরে পূর্ব ভারত থেকেই নিয়ন্ত্রিত হতে শুরু করে সারা দেশের যাবতীয় স্ক্র্যাপ ব্যবসা। তবে গত এক থেকে দেড় দশকে বজরংবলীর সেই বোলবোলা অনেকটাই স্তিমিত। ব্যবসার অনেকটাই এখন উত্তর ভারত ও দেশের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়েছে। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে, ধূলাগড়ের মতো জায়গাতেও গড়ে উঠেছে বহু স্ক্র্যাপ গোডাউন।
বালি পুরসভা এলাকার মধ্যে শহরের ব্যস্ততম কেন্দ্রে দিনের অধিকাংশ সময় নো-এন্ট্রি থাকে। বজরংবলীর অবস্থানের কারণে মালবাহী বড় ট্রাক বা ট্রেলার কন্টেনারে মাল নিয়ে আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে বিস্তর অসুবিধা। ফলে অনেক ব্যবসায়ী তাঁদের মূল ব্যবসা জাতীয় সড়ক বা এক্সপ্রেসওয়ের কাছে সরিয়ে নিয়ে গেছেন। আগে মূলত পূর্ব রেলের বেলুড় স্ক্র্যাপ ইয়ার্ডে ডাঁই করে রাখা ছাঁট লোহার স্তূপে লট নম্বর দাগিয়ে সেখানে নিলাম হতো। সেই নিলামে অংশ নেওয়া নিয়ে যেমন ছিল তীব্র রেষারেষি, দাদাগিরি ও বাহুবলের প্রদর্শন।
২০১০-১১ পর্যন্ত এই দস্তুর দেখা গেলেও এখন পুরো নিলামই অনলাইন হয়ে যাওয়ার ফলে এবং পুরোনো বাহুবলীদের তেমন দাপট না থাকায় রেলের স্ক্র্যাপের যোগান কমেছে অনেকটাই। তা ছাড়া রেলের নিলাম পদ্ধতিতে আরও পরিবর্তন এনে যেখানকার বাতিল মাল সেখানেই অনলাইনে নিলামের ফলে নামমাত্র মাল আসছে বজরংবলীতে। এই সঙ্কটে ব্যবসায়ীদের অনেকেই এখন ছাঁট ব্যবসা ছেড়ে নতুন লোহার ব্যবসা শুরু করেছেন। কেউ কেউ পুঁজি লাগিয়েছেন প্রোমোটারিতেও। অল্প কিছু ছোট পুঁজির ব্যবসায়ী ১০-২০ টন মাল কোথাও পেয়ে অন্যের গোডাউন ভাড়া নিয়ে কাটাই করাচ্ছেন। গত মঙ্গলবার যে দুর্ঘটনা ঘটেছে সে ক্ষেত্রেও জানা গেছে অভিযুক্ত ব্যবসায়ী দুর্গাপুর থেকে কিছু ছাঁট মাল কিনেছিলেন। সে সবই কাটাই করা হচ্ছিল ভিক্টোরিয়া মার্কেটের ওই গোডাউনে।
তবে সূত্রের খবর, গ্যাসকাটার দিয়ে বাতিল অক্সিজেন সিলিণ্ডার কাটানোর ঘটনা ঘটেনি। একটি অক্সিজেন ভর্তি সিলিন্ডার দুই মজুর পা দিয়ে গড়িয়ে আনছিলেন। আচমকা সিলিন্ডারের মুখের পিতলের ভালভ খুলে তীব্র বেগে গ্যাস বের হতে থাকে ও বাতাসের সংস্পর্শে এসে তীব্র বিস্ফোরণ ঘটে যায়।