বজরংবলীর বাড়বাড়ন্ত ছিল গত শতকের আশি ও নব্বইয়ের দশক জুড়ে। একদিকে রেলের অকশনের বিপুল পরিমাণ বাতিল লোহা, তামা, পিতলের জোগান, অন্য দিকে অকশন মাফিয়াদের রমরমা। তবে কালের নিয়মে সে সবই আজ অতীত। ব্যবসায় মন্দা এসেছে। টাকাও কমেছে। অবশ্য একটি যন্ত্রণা থেকে রেহাই পেয়েছেন ব্যবসায়ীরা— তা হল জিটি। অর্থাৎ গুন্ডা ট্যাক্স। এক দেড় দশক আগেও টন পিছু গুন্ডা ট্যাক্স দিতেই হতো ব্যবসায়ীদের। এখন অবশ্য সে সবের পাট চুকেছে।রেলের ছাঁট লোহার অকশনের রেষারেষি থেকেই রাখাল দাস, প্রভাত ভট্টাচার্য, সুভাষ সিং, লাল্টু পালেদের মত অকশন মাফিয়াদের উত্থান ও হাড্ডাহাড্ডি লড়াই দেখেছে বজরংবলী। ছাঁট লোহার অকশনকে কেন্দ্র করে খুনোখুনিও কম হয়নি। ক্রাইম থ্রিলারের মতই ৮০-৯০ দশকের সংবাদপত্রের পাতায় সেসব কাহিনি জায়গা করে নিয়েছিল।
সব শেষে সেই ছাঁট লোহার অকশনের হিস্সাকে কেন্দ্র করেই বছর ২০-২২ আগে রাখাল দাসের বাড়িতে খুন হয় বেলুড়ের দোর্দণ্ডপ্রতাপ বাহুবলী প্রভাত ভট্টাচার্য। রাখালের বাড়ির চৌহদ্দিতে পুকুরের নীচে পাঁকের মধ্যে বল্লম দিয়ে গেঁথে রাখা হয়েছিল দেহ। যে দেহ পরে উদ্ধার করেছিল বালি থানার পুলিশ।
সেই সব মাফিয়াগিরি এখন অতীত। তেমনই অতীত বজরংবলীর ব্যবসার সেই বোলবোলা। এক সময়ে দিনে কয়েকশো কোটি টাকার ব্যবসা চলত যে স্ক্র্যাপ বাজারে, সেখানে এখন দিনে ৫০ কোটির ব্যবসা চলে কি না সন্দেহ। তাই গুন্ডা ট্যাক্সের ভয়ও আর নেই। অথচ এই গুন্ডা ট্যাক্স নিয়ে কম গল্প নেই এই বজরংবলী মার্কেটে। বিহারের মাফিয়া অমিত চৌধরির ফোনে সেই সময়ে আতঙ্কে ঘুম ছুটেছিল ব্যবসায়ীদের।
শোনা যায় কখনও ভাইজ্যাগ তো কখনও কাঠমান্ডু তো কখনও দুবাই বা সিঙ্গাপুরে বসে স্যাটেলাইট ফোনে ব্যবসায়ীদের হুমকি দিত অমিত। ডিল ফাইনাল করার জন্য শোনা যায় কখনও সে ডেরা বাঁধত হাওড়ার কোনও হোটেলেও। অমিতকে গুন্ডা ট্যাক্স না দিলে ব্যবসায়ীদের কপালে জুটত সিসের বুলেট। এমনই এক হুমকিকে পাত্তা না দিয়ে মূল্য চোকাতে হয়েছিল কিষানলাল জৈন নামের বজরংবলীর এক ব্যবসায়ীকে।
দিনটা ছিল ২৩ জানুয়ারি, ২০০৭ সাল। সরস্বতী পুজোর দুপুরে বজরংবলীর গদি থেকে স্কুটারে অভয় গুহ রোডের বাড়িতে ফিরছিলেন কিষানলাল জৈন। গিরিশ ঘোষ রোড হয়ে অভয় গুহ রোডে ঢুকতেই ঠিক ডন বস্কো স্কুলের কাছে তিন আততায়ী আধুনিক স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঘিরে ধরে তাঁকে। মুহূর্তে ঝাঁঝরা হয়ে যান ওই ব্যবসায়ী। পরে অপরাধীরা ধরা পড়েছিল। অমিত চৌধরিও এখন বিহারের জেলে বন্দি। তার বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযোগের অন্ত নেই।
একটা সময়ে ২০-৩০ হাজার মজুর, ৫-৬ হাজার ঠেলা, ভ্যান রিকশা, কয়েক হাজার ট্রাক-লরির আনাগোনা লেগে থাকত বজরংবলীর জন্য। বজরংবলীর অনেক গোডাউন এখন উঠে গিয়ে, এখন সেই জমিতে স্কুল-বহুতল উঠছে। বজরংবলীতে রয়েছে বেশ কিছু ওয়েব্রিজ। এখানে ঠেলা, ভ্যান থেকে শুরু করে ট্রাক, লরি সব গাড়ির খালি ও মালসমেত ওজন হয়।
ভিক্টোরিয়া ওয়েব্রিজের এক পুরোনো কর্মী জানালেন, আগে যেখানে সারাদিনে ওয়েব্রিজে অন্তত দশ হাজার টাকা রোজগার ছিল, এখন তা কমে হাজার বারোশোয় ঠেকেছে। রবিবার বিকেলের স্ক্র্যাপ বাজার খাঁ খাঁ করছে। ঠেলা মজুর, গোডাউনে ছাঁট লোহা কাটায় ব্যস্ত দিনমজুর বা গোডাউন ম্যানেজার সকলের গলাতেই ঝরে পড়ছে একরাশ হতাশা।
যদিও লিলুয়া থেকে বেলিলিয়াস রোডে লোহা ও ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের মেরুদণ্ড ছিল এই বজরংবলী। বজরংবলী শুকিয়ে গিয়ে আসলে হাওড়ার ছোট শিল্পের এখন নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছে। তাই নতুন করে সরকারি উদ্যোগে পরিকাঠামো গড়ে তোলা না হলে বজরংবলী ধীরে ধীরে আরও গুটিয়ে যাবে। সকলেই চান বজংবলী তার পুরোনো চেহারায় ফিরুক। কিন্তু সব নিয়ম বিধি মেনে, নতুন ভাবে।