• প্রতিটা ক্লাস রুম বলছে একেকটা গল্প
    আজকাল | ২৪ জুন ২০২৪
  • নীলাঞ্জনা সান্যাল: ক্লাস রুমের দেওয়াল নয়, যেন গল্প–উপন্যাসের পাতা। এক একটা দেওয়াল বলছে এক–‌একটা গল্প। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেই যেন উল্টে যাচ্ছে বইয়ের পাতা। কখনও দেওয়াল বলছে ‘‌আরণ্যক’‌–এর গল্প। কোনও দেওয়াল জুড়ে আবার ‘‌পথের পাঁচালী’‌র অপু–দুর্গার সেই রেলগাড়ি দেখার দৃশ্য। কোনও দেওয়াল জুড়ে আবার শুধুই গুপি গাইন আর বাঘা বাইন, সঙ্গে ভূতের রাজা। আছেন প্রফেসর শঙ্কু, ফেলুদা। কোথাও আবার শুধুই যামিনী রায়। কোনও দেওয়াল জুড়ে আবার ভূগোলের ভূমিরূপ। এমনই অভিনব আঙ্গিকে সেজে উঠছে যাদবপুর বিদ্যাপীঠ। শুধু ক্লাসঘর নয়, করিডর জুড়েও ছড়িয়ে রয়েছে মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থানের বিভিন্ন ‘‌আর্ট’‌। রয়েছে কন্যাশ্রী, সর্বশিক্ষা মিশনের বিভিন্ন লোগো। তিনতলা স্কুলবাড়ির প্রতিটি তলার প্রতিটি ক্লাসঘর, করিডর, সিঁড়ি এভাবেই হয়ে উঠছে রঙিন।

    শুধু দেওয়াল রং করেও স্কুল রাঙানো যেত। তা না করে কেন এই ভাবনা?‌ এভাবে স্কুলকে সাজিয়ে তোলার মূল উদ্যোক্তা স্কুলের প্রধান শিক্ষক পার্থপ্রতিম বৈদ্য বলেন, ‘‌স্কুল মানে তো শুধু ইট–সিমেন্টের কাঠামো নয়, এমন একটা জায়গা, যেখানে এসে ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনা যেমন শিখবে, তেমনই তার সঙ্গে যুক্ত এমন কিছু জানবে যা তাকে মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করবে। তাছাড়া এখনকার ছেলেমেয়েরা পড়ার বইয়ের বাইরে আর কিছু সেভাবে পড়ে না, পড়তে চায়ও না। বই পড়ার অভ্যেসটাই চলে গেছে। কিন্তু বই না পড়লে জানাটা সম্পূর্ণ হয় না। সেই চিন্তাভাবনা থেকেই ক্লাসরুম সাহিত্যিক–লেখকদের গল্প–উপন্যাসের চরিত্রদের ছবিতে সাজিয়ে তোলা হচ্ছে।’‌ আপাতত একাদশ–দ্বাদশের ক্লাস রুম আঁকার কাজ শেষ হয়েছে। একাদশের একটি ক্লাস রুমের চারটি দেওয়াল জুড়েই রয়েছেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। এক দেওয়ালে পথের পাঁচালীর অপু–দুর্গা, সঙ্গে আম আঁটির ভেঁপু। বাকি দেওয়াল জুড়ে আরণ্যক, অপরাজিত, চাঁদের পাহাড়। আরেকটি ক্লাসের দেওয়াল জোড়া শুধু সত্যজিৎ রায়। লেখক, পরিচালক–‌সহ তাঁর সবকটি পরিচয়ই ধরা হয়েছে দেওয়াল জুড়ে। জয়বাবা ফেলুনাথ, সোনার কেল্লার সঙ্গে রয়েছেন প্রফেসর শঙ্কু, বঙ্কুবাবুর বন্ধু, দেবী, আর একটা দেওয়াল জুড়ে সত্যজিৎ রায়ের করা সন্দেশ–এর প্রচ্ছদ। আরেকটি ক্লাসের চারটি দেওয়াল জুড়ে রয়েছেন শুধু যামিনী রায়। পার্থপ্রতিমবাবু বলেন, ‘‌ছেলেমেয়েরা অনেকটা সময় স্কুলেই থাকে। ওদের চোখের সামনেই এগুলো সব সময় থাকবে। ফলে এই বইগুলো পড়তে ওরা উৎসাহী হবে। ফেলুদা পড়া থাকলেও, সত্যজিৎ রায় কে ছিলেন সেই সম্পর্কে ওরা জানতে উৎসাহী হবে। যামিনী রায় কে, তাঁর আর্ট কী, সেই সম্পর্কে জানারও ক্ষিদে তৈরি হবে। ক্লাস সেভেনের ক্লাস রুমের এক একটা দেওয়ালে যেমন বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন ভাগ, ভূমিরূপ, নদীর উৎপত্তি, মালভূমি, ইত্যাদি আঁকা হচ্ছে। ফলে, বইয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সারাক্ষণ চোখের সামনে দেখায় গোটা বিষয়টাই মাথায় গেঁথে যাবে।’‌

    শুধু ক্লাস রুমই নয়, সেজে উঠছে করিডরও। মহারাষ্ট্রের ওরলি আর্ট, মধ্য প্রদেশের গোন্ড উপাজাতিদের ঐতিহ্যবাহী আর্ট, সঙ্গে রাজস্থানের পিচওয়াই শিল্পের আলপনা করিডরের দেওয়ার জুড়ে। সঙ্গে রয়েছে বাংলার শান্তিনিকেতনের আলপনা। এভাবে স্কুলকে সাজিয়ে তোলার সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের ভারতের প্রাচীন কিছু শিল্পকলা সম্পর্কে অবগত করানোই মুখ্য উদ্দেশ্য বলে জানান পার্থপ্রতিমবাবু। এছাড়াও বিভিন্ন ক্লাসের পড়ুয়ারা পাঠ্যবইতে যা পড়ছে, তারই কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বেছে নিয়ে সেগুলি আঁকা হচ্ছে। যেমন দোতলা থেকে তিনতলার ওঠার সিঁড়ির দেওয়ালে গৌতম বুদ্ধের জীবনী, তাঁর মতাদর্শ, অস্টাঙ্গিক মার্গ, বোধিবৃক্ষ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কাজটা শুরু হয়েছে গত বছরের নভেম্বর থেকে। স্কুলের নিজস্ব তহবিলের অর্থ দিয়েই আপাতত কাজ চলছে। তাঁর স্কুলের প্রতিটি শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর পাশাপাশি কলকাতা জেলা শিক্ষা দপ্তরের আধিকারিকদেরও সহযোগিতা তিনি পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন পার্থপ্রতিমবাবু। ‌‌
  • Link to this news (আজকাল)