বিধানসভার অপমান বিধায়কেরও অপমান!
মঙ্গলবার সকাল থেকেই তৃণমূলের দুই জয়ী বিধানসভা প্রার্থী সায়ন্তিকা এবং রায়াতের শপথ নিয়ে সরগরম বাংলা রাজনীতি। এক দিকে রাজ্যপাল চান সায়ন্তিকারা রাজভবনে এসে তাঁর কাছে শপথ পাঠ করুন। অন্য দিকে, সায়ন্তিকাদের বক্তব্য, তাঁরা রাজভবনে যাবেন না। কারণ প্রথমত, রাজভবন তাঁদের ভবিষ্যতের কর্মক্ষেত্র নয়। তাঁদের কাজ করতে হবে বিধানসভায়। আর রাজভবন থেকে সেই বিধানসভার অধ্যক্ষকে অপমান করা হয়েছে। তাই তাঁরা কোনও ভাবেই সেখানে শপথ পাঠ করতে যাবেন না। মঙ্গলবার বেলা থেকে শুরু হওয়া এই ঘটনাপ্রবাহের শেষ দফায় বিধানসভার স্পিকারের কাছেই পরামর্শ চাইতে এসেছিলেন সায়ন্তিকারা। দীর্ঘ আড়াই ঘণ্টা তাঁদের কথা হয় বিধানসভায় বিমানের ঘরে। তার পরেই বেরিয়ে নিজেদের সিদ্ধান্তের কথা জানান।
সাংবিধানিক যুক্তি-তর্ক
ঘটনার সূত্রপাত, দিন কয়েক আগে। তৃণমূল অভিযোগ করে, রাজভবনের সবুজ সঙ্কেত না পাওয়ায় ভোটে জিতেও শপথ নিতে পারছেন না বরাহনগরের বিধানসভা উপনির্বাচনে জয়ী তৃণমূল প্রার্থী সায়ন্তিকা এবং ভগবানগোলা বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে জয়ী রায়াত। বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক শুরু হতেই রাজভবনের তরফে ব্যক্তিগত ভাবে চিঠি পাঠিয়ে শপথ নিতে আসতে বলা হয় সায়ন্তিকা এবং রায়াতকে। যদিও বিধানসভার অধ্যক্ষকে এ বিষয়ে কিছু জানায়নি রাজভবন। পরে বিধানসভার সচিবালয়ের কাছ থেকে বিধায়ক সংক্রান্ত কিছু তথ্য চেয়ে পাঠায় রাজভবন। এতেই ক্ষুব্ধ হন বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ২০ জুন একটি চিঠি দিয়ে রাজ্যপালকে সাংবিধানিক নিয়ম স্মরণ করিয়ে দেন। অন্য দিকে সায়ন্তিকারাও চিঠি দিয়ে রাজ্যপালকে জানিয়ে দেন, তাঁরা রাজভবনে নয়, বিধানসভায় অধ্যক্ষের কাছেই বিধায়ক হওয়ার শপথ নিতে চান। সোমবার পর্যন্ত বিষয়টি এখানেই থমকে ছিল, আচমকাই মঙ্গলবার সকালে পরিস্থিতি নতুন মোড় নেয়। রাজভবনের তরফে এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে একটি বিস্তারিত জবাবি পোস্ট করা হয়। তাতে বিধানসভার স্পিকারের কড়া সমালোচনা করে রাজ্যপাল জানান, নবনির্বাচিত প্রার্থীদের শপথ নেওয়ার বিষয়ে যে চিঠি স্পিকার দিয়েছেন, তাতে রাজ্যপাল এবং রাজভবনের সাংবিধানিক মর্যাদাকে অবজ্ঞা করা হয়েছে। কারণ সংবিধানেই বলা আছে বিধায়কদের শপথগ্রহণের বিষয়ে শেষ কথা বলবেন রাজ্যপাল।
রাজভবনের দ্বিতীয় চিঠি
মঙ্গলবার বিমানের সমালোচনা করে ওই পোস্টের পরেই সায়ন্তিকা এবং রায়াতের কাছে ইমেল মারফত চিঠি পৌঁছয় রাজভবনের। রাজভবন সূত্রেই জানা যায়, ওই চিঠিতে রাজ্যপাল সায়ন্তিকা এবং রায়াতকে বুধবার দুপুরে শপথগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। চিঠি পাওয়ার কথা আনন্দবাজার অনলাইনের কাছে স্বীকারও করেছিলেন সায়ন্তিকারা। তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বিকেল ৪টে নাগাদ তাঁরা এসে হাজির হন বিধানসভায় স্পিকার বিমানের ঘরের সামনে। বিমানের কাছেই জানতে চান, তাঁদের কী করণীয়? রাজ্যের বিধায়ক হিসাবে শপথগ্রহণ করতে কি তবে রাজভবনেই যেতে হবে তাঁদের? না কি বিধানসভাতেই ব্যবস্থা করা হবে শপথগ্রহণের? দীর্ঘ আলোচনার পরে রাজভবনের ভূমিকায় উষ্মাপ্রকাশ করেই সায়ন্তিকারা বলে ফেলেন, ‘‘জিতে কি কোনও অপরাধ করে ফেলেছি আমরা। এত দিন পরেও শপথ নিতে পারব না কেন? কেন অকারণ জটিলতা তৈরি করছে রাজভবন?’’
পুরনো শপথের ইতিহাস
সায়ন্তিকার প্রশ্নের জবাব অবশ্য রাজ্যপাল দিয়ে রেখেছেন তাঁর সমাজমাধ্যমের পোস্টেই। বিধায়কদের শপথগ্রহণ করানোর ব্যাপারে রাজভবন এবং রাজ্যপালের অধিকারের বিষয়টি কতটা আইনসঙ্গত, তা বোঝাতে তিনি সাংবিধানিক নিদানের পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্ট এবং হাই কোর্টের নির্দেশের উদাহরণও টেনে এনেছিলেন। একই সঙ্গে বলেন, এই নিদান না মানলে বিধায়কদের আর্থিক জরিমানার শাস্তি দেওয়ারও নিদান আছে সংবিধানে।
হবে কি আদৌ শপথ?
বিধায়কদের শপথ নিয়ে রাজভবন এবং বিধানসভার টানাপড়েন আগে হয়নি তা নয়। এর আগে ধূপগুড়ির তৃণমূল বিধায়ক নির্মলচন্দ্র রায়ের শপথগ্রহণ নিয়ে এই একই সমস্যা হয়েছিল। সমস্যা হয়েছিল বাবুল সুপ্রিয়ের শপথের সময়েও। তবে প্রতি বারই কোনও না কোনও সমাধান সূত্রে এসে পৌঁছেছে দু’পক্ষ। কিন্তু বুধবার তেমনটা হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে মনে করছেন না বাংলার রাজনৈতিক কারবারিদের অনেকেই। রাজভবন থেকে বিধানসভা হাঁটা পথে ৯ মিনিটের দূরত্ব। কিন্তু আমন্ত্রণকারী বা আমন্ত্রিতদের কেউই হয়তো সেইটুকু দূরত্ব অতিক্রম করবেন না। সে ক্ষেত্রে জয়ী দুই তৃণমূল প্রার্থীর বিধায়ক হয়ে উঠতে আর কত সময় লাগে সেটাও দেখার।