• 'যেতে পারি, কিন্তু বেশি ভাড়া চাই’, অ্যাপ-বাইক চালকদের দৌরাত্ম্য বাড়ছেই...
    আজকাল | ২৬ জুন ২০২৪
  • শুভাশিস চট্টোপাধ্যায়: বছর কয়েক আগেও যে হলুদ ট্যাক্সিকে যাত্রী ‘রিফিউজাল’ কিংবা অতিরিক্ত ভাড়ার অভিযোগে দাগিয়ে দেওয়া হত, সেটাই এখন রীতিমতো রপ্ত করে ফেলেছেন নামী অ্যাপ–নির্ভর মোটরবাইক চালকেরা। ‌নির্ধারিত ভাড়ার বদলে অতিরিক্ত ভাড়ার চাহিদায় মহানগরের সর্বত্র তাঁদের জন্য ব্যাপক নাকাল সাধারণ যাত্রীরা। শুধু তা–ই নয়, অনলাইনে বাইক বুক করে অফলাইনে যাত্রী নিয়ে যাওয়ার অসাধু পদ্ধতিও বেড়ে গেছে দারুণভাবে। বিশেষত, রেল স্টেশন, বাস টার্মিনাস কিংবা বাজার–‌সংলগ্ন এলাকায় এই সব বাইক–‌চালকের দৌরাত্ম্য দিনে–দিনে প্রবল হয়ে উঠছে। হাওড়া, শিয়ালদা, সাঁতরাগাছি, শালিমার, কলকাতা রেল স্টেশন এলাকা ছাড়াও কিছু মেট্রো স্টেশন এলাকাতেও এদের প্রভাব ছড়িয়েছে। তার ওপর অন্য কোনও পথচলতি বাইকচালক যদি অ্যাপ–নির্দিষ্ট ভাড়ায় ওই সমস্ত এলাকা থেকে যাত্রী তুলতে উদ্যোগী হন, তাঁদের কপালেও জোটে অশেষ দুর্ভোগ। অভিযোগ, এই সব দৌরাত্ম্যকারী তখন ‘ফেয়ার প্রাইস’ মোটো–চালকদের বিরুদ্ধে দলবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়ায় এবং যাত্রীদের নামাতে বাধ্য করে।

    যাত্রী–‌প্রত্যাখ্যানের এই অসভ্যতা ঠিক কতটা, তা যাচাই করতে অফিস–‌টাইমে যাত্রী সেজে শিয়ালদা স্টেশনের বাইরে দাঁড়াতেই টের পেলাম, অভিযোগ অক্ষরে–অক্ষরে সত্যি। স্টেশন–লাগোয়া এক শপিং মলের সামনে অপেক্ষায় রয়েছে বাইকের একটি দল। তার কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে হাওড়ার উদ্দেশে অ্যাপ–মোটোয় যাত্রা নিশ্চিত করে বোতাম টিপতেই মুহূর্তের মধ্যে ফোন এল এক চালকের। হিন্দিতে প্রথম প্রশ্ন: কোথায় আছেন? উত্তর দিলাম, এই তো মলের সামনে!‌ দ্বিতীয় প্রশ্ন:‌ কোথায় যাবেন? উত্তর দিলাম, হাওড়া স্টেশন। তৃতীয় প্রশ্ন:‌ ভাড়া কত দেখাচ্ছে? উত্তর দিলাম, ৫৫ টাকা। চালক জানাল, বলুন, কত দেবেন? উত্তর দিলাম, অ্যাপে যা দেখাচ্ছে তা–ই দেব। ও–‌প্রান্ত থেকে কথা ভেসে এল। এত কম টাকায় কেউ যাবে না। ২০০ টাকা লাগবে। কারণ, খালি গাড়ি নিয়ে ফিরতে হবে। লাস্ট ১৫০ টাকা দিলে যেতে পারি। ‘ক্যান্সেল রাইড’ টিপে দ্বিতীয় চালকের অপেক্ষার কিছুক্ষণের মধ্যেই নতুন চালকের ফোন। এবং আবারও হুবহু সেই একই কথোপকথন। বলতে বলতেই মুহূর্তের মধ্যে আরেক চালক সামনে হাজির। অতিরিক্ত ভাড়া ছাড়াও তার দাবি আবার আরও ওপরে। ‘অফলাইনে যাবেন?’ একটু এগিয়ে যেতেই কান ঘেঁষে অন্য এক বাইক–‌চালক ফিসফিসিয়ে শুনিয়ে গেলেন, ‘বি আর সিং হাসপাতালের কাছে আসুন। ফেয়ার প্রাইসে আমি নিয়ে যাব।’ সেই চালকের মুখেই শুনলাম, ‘এখানে এদের বড় গ্রুপ আছে। আমরা প্রতিবাদ করতে গেলে মার খেতে হবে। এরা যেমন অতিরিক্ত ভাড়া দাবি করে, তেমনই অফলাইনে যেতেও জোর খাটায়। অ্যাপ পরিবহণ সংস্থাগুলোর চোখে ধুলো দিয়ে, কর্তৃপক্ষের প্রাপ্য কমিশনকে কঁাচকলা দেখিয়ে পুরো টাকাটাই পকেটস্থ করতে অফলাইনে তৎপর বহু বাইক–‌চালক। শুধু তা–ই নয়, আমাদের মতো যাঁরা সংস্থাগুলোর নির্ধারিত ভাড়ায় যেতে চান, তাঁদের ওই সব স্পট থেকে যাত্রী তুলতে ওরা বাধা দেয়। প্রতিবাদ করলেই বলে, কিচ্ছু হবে না, আমাদের সব সেটিং আছে।’

    আরও একবার চক্ষু–‌কর্ণের বিবাদভঞ্জন করতে রাত বারোটা নাগাদ সাঁতরাগাছি স্টেশনের বাইরে দাঁড়াতে নজরে পড়ল একই ছবি। যাত্রীর অপেক্ষায় বাইক–‌চালকের দঙ্গল। স্টেশন থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে বাইক বুক করতে ভাড়া দেখাল ২৮০ টাকা। আবারও সেই ফোন এবং বেশি ভাড়ার দাবি। যাত্রা বাতিল করার কিছুক্ষণ পরেই অ্যাপ–নির্ধারিত ভাড়ার এক চালকের বাইকে চড়ে দু’চাকা এগোতেই রাস্তা আটকাল দু’জন। তাদের হুমকি, এখান থেকে অন্য কোনও পথচলতি বাইক–‌চালকের যাত্রী নেওয়া যাবে না। চালক রুখে দাঁড়াতে তারা পিছু হটল। বাইকে যেতে যেতে মধ্যবয়সি চালক বললেন, ‘এদের দৌরাত্ম্যেই তো বহু বাইকযাত্রী অ্যাপ–বাইক থেকে ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। যা খুশি ভাড়া দাবি, না পোষালে ইচ্ছেমতো রাইড ক্যানসেল করা ওদের ক্রনিক রোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে খবরদার, ভুলেও অফলাইনের ফাঁদে জড়াবেন না। আমার ‘কেন’ প্রশ্নের উত্তরে চালক গোবিন্দকুমার সিংহ ‌বললেন, ‘অনলাইনে যাত্রী এবং চালক দু’‌জনেরই নিরাপত্তা সুনিশ্চিত শুধু নয়, পথে দুর্ঘটনা ঘটলে মিলবে বিমার টাকাও।'
  • Link to this news (আজকাল)