• 'শিশু চুরি’-র গুজবেই মারমুখী রেলযাত্রীরা, জিআরপি ওসি বললেন, ‘আমি নিশ্চিত…’
    এই সময় | ২৭ জুন ২০২৪
  • এই সময়, বিরাটি: সকালের ব্যস্ত ডাউন দত্তপুকুর লোকাল। শিয়ালদহগামী ট্রেনের লেডিজ় কম্পার্টমেন্টের গিজগিজে ভিড়ে গোলাপি জামাপ্যান্ট পরা ফর্সা ফুটফুটে একটি শিশুকে কোলে নিয়ে বসে ছিলেন মধ্যবয়সি এক মহিলা। চোখের চাউনি কিছুটা অন্যমনস্ক, উস্কোখুস্কো চুল, পরনের ফুলছাপ শাড়িটাও অবিন্যস্ত। আশপাশের যাত্রীরা মাঝেমধ্যেই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছিলেন মহিলাকে।সকাল সাড়ে ন’টা নাগাদ বারাসত থেকে ট্রেন বিশরপাড়া স্টেশনে পৌঁছতেই তীব্র গরমে শিশুটি একবার কেঁদে ওঠে। বাকি যাত্রীরা যেন এই ‘কিউ’টারই অপেক্ষায় ছিলেন। মুহূর্তের মধ্যে মারমার করে মহিলার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বাকি যাত্রীরা। রটে যায়, ‘ছেলেধরা’ মহিলা বাজারের ব্যাগে করে ‘চুরি’ করে নিয়ে যাচ্ছে দুধের শিশুকে!

    বিশরপাড়া থেকে বিরাটি স্টেশনের দূরত্ব মেরেকেটে মিনিট তিন। ওইটুকু সময়ের মধ্যেই চলন্ত ট্রেনে ছেলেধরা সন্দেহে সহযাত্রীদের হেনস্থা, চড়-থাপ্পড় শুরু হয়ে যায়। ততক্ষণে ট্রেন থেমেছে বিরাটি স্টেশনের এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে। ট্রেন থেকে নামিয়ে আনা হয় বাচ্চা কোলে ওই মহিলাকে। আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে ছেলেধরার গুজব। অফিস টাইমে ব্যস্ত সময়ে প্ল্যাটফর্মে ভিড় ছিলই যাত্রীদের। কয়েক মিনিটের মধ্যে স্টেশন চত্বরে জড়ো হয়ে যায় হাজার দুয়েক উত্তেজিত মানুষ।

    মারমুখী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে হিমশিম খেতে হয় জিআরপি-কে। পরিস্থিতি বেগতিক বুঝে নামানো হয় রেল পুলিশ, র‍্যাফ ও নিমতা থানার বিরাট পুলিশ বাহিনী। পুলিশ বাচ্চা এবং মহিলাকে সরিয়ে নিয়ে যেতেই রাগে ফুঁসে ওঠে ভিড়। ওই মহিলাকে তাদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার দাবিতে অফিস টাইমে শুরু হয়ে যায় রেল অবরোধ। মিনিট দশেক অবরোধের পর শেষ পর্যন্ত লাঠি উঁচিয়ে ক্ষিপ্ত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক করে পুলিশ।

    গত বেশ কয়েক দিন ধরে উত্তর ২৪ পরগনার বেশ কিছু এলাকায় ছেলেধরা গুজবে গণপিটুনির শিকার হয়েছেন অন্তত পাঁচজন। তাঁদের প্রায় সকলেই কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন। এ দিন আক্রান্ত মহিলার কথাবার্তাতেও অসংলগ্নতা থাকায় উত্তেজিত মানুষকে তিনি বোঝাতে পারেননি কোলের শিশুটি তাঁর নিজের সন্তান। অবরোধ উঠিয়ে ঘটনার তদন্ত শুরু করে বারাসত জিআরপি থানার পুলিশ।

    জিআরপি থানায় এনে ওই মহিলাকে জেরা করেন খোদ জিআরপি ওসি রূপসেনা পারভিন। পুলিশ জানতে পারে, আদতে ওডিশার বাসিন্দা ওই মহিলা স্বামীর সঙ্গে থাকেন দমদমের রেলবস্তিতে। মানসিক ভারসাম্যহীন মহিলার মোট ছ’টি সন্তান আছে। জনরোষের হাত থেকে উদ্ধার করে বিরাটি স্টেশন থেকেই শিশুটিকে দমদম জিআরপি থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। দুপুরে বাচ্চাটিকে ফের আনা হয় বারাসত জিআরপি থানায়। আক্রান্ত মহিলার কোলে তুলে দিতেই কান্না থামিয়ে একেবারে স্বাভাবিক হয়ে যায় শিশুটি।

    মায়ের বুকের দুধ খাওয়ার জন্য ছটফট করতে থাকে সে। দুধ খাওয়ার পর মায়ের কোলে খেলতে খেলতে ঘুমিয়েও পড়ে শিশুটি। গোটা ঘটনাটি বারাসত জিআরপি থানার ওসির ঘরে হয়েছে। মা ও সন্তানের এই দৃশ্যের প্রত্যক্ষদর্শী জিআরপি ওসি রূপসেনা পারভিন বলেন, ‘মহিলা জেরায় স্বীকার করেছেন বাচ্চাটি তাঁরই। আমি নিজে একজন মা। বাচ্চাটি যে ভাবে মহিলার কোলে স্বাভাবিক ছিল, যে ভাবে হাসছিল, খেলছিল, বুকের দুধ খাচ্ছিল তাতে আমি নিশ্চিত ওই বাচ্চার মা উনিই। স্রেফ ছেলেধরা গুজবে মায়ের কোল থেকে বাচ্চাকে কেড়ে নিয়ে ধুন্ধুমার ঘটনা ঘটাল একদল মানুষ।’

    মহিলার ঠিকানা যাচাই করতে এ দিন বিকেলেই জিআরপি থানার পুলিশের টিম মা ও বাচ্চাকে নিয়ে দমদমের রেল বস্তিতে যায়। মহিলার বয়ান অনুযায়ী তাঁর থাকার জায়গা যাচাই করে পুলিশ। জিআরপি সূত্রে জানা গেছে, রেলবস্তির বাসিন্দাদের সঙ্গেও কথা বলেন তাঁরা। কিন্তু সেখানে মহিলার বাসস্থান খুঁজে পাওয়া যায়নি। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ওই মহিলাকে মাস দেড়েক আগে দমদমের চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে থাকতে দেখেছিলেন কেউ কেউ। তার পর থেকে তাঁকে আর দেখা যায়নি।

    জিআরপি ওসি জানিয়েছেন, ‘মহিলার বাড়ি খুঁজে না পেলে রাতটা তাঁকে বারাসত জিআরপি থানাতেই রাখা হবে। বৃহস্পতিবার মহিলার মেডিক্যাল টেস্ট করানো হবে। মাস ছয়-সাত আগে মহিলার কোনও বাচ্চা হয়েছিল কি না সেটাও জানব আমরা। এর পর তাঁকে বারাসত কোর্টে তোলা হবে।’

    কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে বিরাটির ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল শিয়ালদহ-বনগাঁ শাখার হাবরা স্টেশনে। এখানেও বাচ্চা চুরির অভিযোগে রেলযাত্রীদের হেনস্থার মুখে পড়তে হয় বছর পঁয়ত্রিশের মহিলাকে। এ দিন দুপুরে হাবরা ১ নম্বর প্ল্যাটফর্মে এক মহিলা সদ্যোজাত সন্তানকে নিয়ে প্ল্যাটফর্মে ঘুরছিলেন। তাঁকে দেখে ছেলেধরা সন্দেহ হয় যাত্রীদের। তাঁরাই ওই মহিলাকে ধরে নিয়ে আসে জিআরপি থানায়।

    প্ল্যাটফর্মে ফিরে আসার পর ফের ছেলেধরা সন্দেহে যাত্রীদের হেনস্থার মুখে পড়তে হয় মানসিক ভাবে অসুস্থ ওই মহিলাকে। যাত্রীদের ভিড় দেখে এগিয়ে আসেন এক তরুণী। বাচ্চাটিকে কোলে তুলে গণপিটুনির হাত থেকে তিনি ওই মহিলাকে ফের নিয়ে আসেন জিআরপি থানায়। পুলিশ ওই মহিলার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারে শিশুটি তাঁরই।
  • Link to this news (এই সময়)