বিভিন্ন হকার সংগঠনের নেতাদের দাবি, কোভিড-পরবর্তী সময়ে কলকাতার ফুটপাথে হকারদের মাথার উপর নির্দিষ্ট মাপের ছাউনি করার কথা বলেছিল পুরসভা। গড়িয়াহাটে বিষয়টি ‘সংগঠিত’ ভাবে হলেও সর্বত্র তা হয়নি। বেহালার মতো জায়গায় ছাউনি হলেও তা বিক্ষিপ্ত ভাবে হয়েছে। সেই সময়েই পুরসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পুলিশ ফুটপাথে হলুদ রঙের ‘গণ্ডি’ কেটে দিয়েছিল। উদ্দেশ্য: সেই ‘লক্ষ্ণণরেখা’ পেরিয়ে যাতে দোকানের পণ্য ফুটপাথের দখল না নেয়। মুখ্যমন্ত্রী মমতার নির্দেশের পর সেই হলুদ লক্ষ্মণরেখা ফিরিয়ে আনতে চাইছে প্রশাসন। তা নিয়েই সমস্যা।
সাধারণ ভাবে মমতা যে কোনও ধরনের ‘উচ্ছেদ’-এরই বিরোধী। এ নিয়ে অতীতে তাঁর সঙ্গে কলকাতার মেয়র সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের দ্বন্দ্বও বেধেছিল। যেমন দ্বন্দ্ব বেধেছিল জলকর বসানো নিয়ে। সেই ‘মানবিক’ মমতা উচ্ছেদ নিয়ে কঠোর নির্দেশ দেওয়ায় অনেকেই অবাক হয়েছেন। কিন্তু পাশাপাশিই প্রশাসনের একাংশের বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রী ‘বাস্তববাদী’ হয়েছেন। তিনি হকার-উচ্ছেদ নয়, ‘দখলদার’ উচ্ছেদ করতে চাইছেন। এমনিতেই আধুনিক শহরের মাপকাঠিতে ফুটপাথে ‘স্থায়ী’ কাঠামো করা অসমীচীন। তবে কলকাতার মতো একটি শহরে অর্থনৈতিক কারণেই ফুটপাথ একেবারে ‘হকারমুক্ত’ করা কঠিন। কলকাতার মেয়র পারিষদ (রাস্তা) তথা তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসির দক্ষিণ কলকাতা জেলা সভাপতি অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘যে ভাবে হকার উচ্ছেদ বলে প্রচার করা হচ্ছে, বিষয়টা তা নয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কারও পেটে লাথি মারার পক্ষপাতী নয়। তিনি সকলের পেটে ভাত দিতে চান। যারা বেআইনি ভাবে ফুটপাথ দখল করেছে, তাদেরই প্রশাসন সরিয়ে দিচ্ছে।’’
বস্তুত, কলকাতা-সহ গোটা রাজ্যে ফুটপাথে দোকান বা হকারদের বসা নতুন কোনও বিষয় নয়। যুগ যুগ ধরে তা হয়ে আসছে। কিন্তু ইদানীং দেখা যাচ্ছে, ফুটপাথে যে হকারেরা ছিলেন, তাঁদের পাশাপাশি আরও ডালা, গাড়ি, ভ্যান যোগ হয়েছে। প্রশাসনিক সূত্রের বক্তব্য, গত তিন-চার বছরে যাঁরা নতুন করে ফুটপাথের উপর বসেছেন, তাঁদেরই সরানোর কথা বলা হয়েছে। গড়িয়াহাটে গত ২৮ বছর ধরে হকারি করেন হুগলির ভদ্রেশ্বরের বাসিন্দা তপন দাস। তাঁর কথায়, ‘‘আত্মীয়স্বজন থেকে পরিচিতেরা আমায় ফোন করছেন। কিন্তু তাঁদের সকলকেই আমি বলেছি, আমাদের কিছু হবে না। কারণ, আমরা নিয়ম মেনে দোকান চালাই।’’
নিয়ম কী?
সরকারি লিখিত কোনও নিয়মের কথা কেউই বলতে পারছেন না। তবে হকারদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতাদের বক্তব্য, কলকাতা-সহ বিভিন্ন জেলায় স্থানীয় প্রশাসনের এই মর্মে নির্দেশিকা রয়েছে যে, যাঁরা হকারি করেন, তাঁরা ফুটপাথের এক ভাগ পর্যন্ত দোকান দিতে পারবেন। বাকি তিন ভাগ জায়গা ফাঁকা রাখতে হবে পথচারীদের হাঁটাচলার জন্য। উল্লেখ্য, বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সংগঠন হকারদের পরিচিতিপত্র দেয়। অনেক জায়গায় স্থায়ী ভাবে হকারদের স্টলও করে দেওয়া হয়েছে। যেমন, দেশপ্রিয় পার্কের সামনে স্থায়ী দোকান রয়েছে। হাওড়াতেও মঙ্গলাহাটের জায়গায় স্থায়ী দোকান করা হয়েছে অনেক দিন আগে। কলকাতা শহরেও পুরসভার তরফে হকারদের ‘রেজিস্ট্রেশন’ (নথিভুক্তিকরণ) দেওয়া শুরু হয়েছে। তবে সেই রেজিস্ট্রেশন পাওয়া, না-পাওয়া নিয়েও পছন্দ-অপছন্দের অভিযোগ রয়েছে।
কোভিডের পরে হকারবৃদ্ধি
যাঁরা দীর্ঘ দিন ধরে হকারি করছেন, তাঁদের অনেকেরই বক্তব্য, কোভিড-পরবর্তী সময়ে কলকাতা-সহ শহরতলির ফুটপাথে হকারের সংখ্যা ব্যাপক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। মূলত ওই সময় থেকেই তিন ভাগ ফুটপাথ ‘দখল’ শুরু হয়। কলকাতা, সল্টলেক, হাওড়া, উত্তর ২৪ পরগনার বিভিন্ন অংশে এই সংখ্যা চোখে পড়ার মতো। মূলত এই অংশকেই উচ্ছেদ করা শুরু করেছে নবান্ন। শাসক শিবির তো বটেই, বিরোধী শিবিরের শ্রমিক সংগঠনের নেতারাও ঘরোয়া আলোচনায় মানছেন, নতুন করে যাঁরা ফুটপাথ দখল করেছেন, সেই ‘বেআইনি’ দখলই মুক্ত করতে পদক্ষেপ করছে প্রশাসন। কিন্তু সহজবোধ্য কারণেই তাঁরা প্রকাশ্যে সে কথা বলতে পারছেন না।
দায় কার?
পুলিশ-প্রশাসনের নাকের ডগায় ফুটপাথ ‘দখল’ হয়ে যাওয়ার দায় কার? এই প্রশ্নেই রাজনৈতিক আকচাআকচি শুরু হয়েছে। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী যেমন সরাসরি তৃণমূলকে কাঠগড়ায় তুলে তাঁর এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে পোস্ট করেছেন, ‘পুলিশ-প্রশাসন বছর বছর তোলা নেওয়ার বিনিময়ে ব্যবসা করার অবৈধ অনুমতি দিয়েছে। সেই তোলার টাকা কোথায় গেল? কে ভাগ পেল? সেই টাকা উদ্ধার হবে? পুলিশকর্তাদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেওয়া হবে?’ সিপিএমের শ্রমিক সংগঠন সিটু নেতা প্রতীপ দাশগুপ্তের বক্তব্য, ‘‘স্থানীয় তৃণমূল নেতা এবং পুলিশ মিলে তোলা নিয়ে গরিব মানুষকে ফুটপাথে বসিয়েছে। এখন তাঁদের এক রাতের মধ্যে উচ্ছেদ করে দেওয়া হচ্ছে। এর চেয়ে নির্মম আর কী হতে পারে? হয় বিকল্প বন্দোবস্ত করুক সরকার। না হয় যে টাকা লুট হয়ে কালীঘাট পর্যন্ত গিয়েছে, তা ফেরত দিক। না হলে বড় আন্দোলন হবে।’’ বিরোধীদের সেই বক্তব্য প্রত্যাশিত ভাবেই উড়িয়ে দিয়েছেন অভিজিৎ। যদিও গত সোমবার নবান্নের বৈঠকে দলের নেতা, বিধায়ক, কাউন্সিলর এবং প্রশাসনের একাংশকেই ‘তোলাবাজ’ আখ্যা দিয়েছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী।
বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে নিয়ম চালু হয়েছিল, কলকাতায় যত চার রাস্তার মোড় রয়েছে, তার ৫০ বর্গফুটের মধ্যে কেউ ফুটপাথ ‘দখল’ করতে পারবে না। তবে তা বাম আমলে বাস্তবায়িত হয়নি। তৃণমূলের জমানায় হকারের সংখ্যা বেড়েছে। যা মাত্রা ছাড়িয়েছে কোভিডের সময়ে। শাসকদলের একাংশের বিরুদ্ধে হকারদের এনে ফুটপাথে ‘বসিয়ে’ দিয়ে তাঁদের কাছ থেকে দিনপ্রতি টাকা আদায়ের কথাও কান পাতলেই শোনা যায়। যিনি জিন্সের ট্রাউজ়ার্স বিক্রি করেন, তাঁর যেমন শাসকদলের জন্য প্রতিদিনের ‘রেট’ বাঁধা রয়েছে, তেমনই আবার যিনি মহিলাদের ঘরে পরার বিভিন্ন পরিধেয় ডালায় চাপিয়ে বিক্রি করেন, তাঁরও ‘রেট’ বাঁধা রয়েছে। সেই অর্থের বিনিময়ে তাঁরা ফুটপাথ ‘দখল’ করার অধিকার অর্জন করেন। পাশাপাশিই অর্জন করেন ‘সুরক্ষা’। যেখানে ‘বেআইনি’ অধিকার ‘আইনি’ হয়ে যায় রাজনীতির দাক্ষিণ্যে। যে রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, এই ছবি পাল্টায় না। মমতার প্রশাসন কড়া হওয়ায় এঁরাই পড়েছেন সমস্যায়।
বৃহস্পতিবার নবান্নের বৈঠকের আগে তাঁদের একটা বড় অংশ আশায় বুক বাঁধছেন, ‘প্রশাসক’ মমতা ‘দিদি’ হয়ে একটা সুরাহার পথ বাতলে দেবেন।