আপনাদেরও কি পুলিশ সতর্ক করে গিয়েছে? প্রশ্ন শুনেই বিরক্ত সেলাইয়ে মগ্ন মহিলা তেলেভাজা বিক্রেতাকে দেখিয়ে বললেন, ‘‘আমি ওর ভাড়াটে। যা বলার ও বলবে।’’ ভাড়াটে মানে? ফুটপাতেও ভাড়া হয়? নিচু স্বরে মহিলা বললেন, ‘‘মাসে ছ’হাজার টাকা দিতে হয়। আলো জ্বালানোর খরচ আলাদা। বাল্ব-পিছু প্রতিদিন ৩০ টাকা। এর পরে আবার দলের লোক এসে প্রতিদিন ১০০ টাকা ভাড়া নিয়ে যান!’’ কোন দলের লোক? উত্তর আসে না।
তত ক্ষণে আলোচনায় ঢুকে পড়েছেন তেলেভাজা বিক্রেতা। উত্তেজিত ভাবে বললেন, ‘‘টিনের ছাউনি পেতে ২৬ হাজার ৪০০ টাকা দিতে হয়েছে। প্রতিদিন আরও ২০০ টাকা করে ফান্ডে দিতে হয়। তাই ভাড়া বসিয়েছি!’’ এর পরে এক মধ্যবয়সি বললেন, ‘‘আমাদের বসিয়েছিলেন যাঁরা, তাঁরাই এখন তুলতে চাইছেন! কিন্তু এই যে এত টাকা দিলাম, তার কী হবে?’’
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নবান্নের সভাঘর থেকে ফুটপাত জবরদখল হওয়া নিয়ে পুলিশ-প্রশাসন এবং নেতা-মন্ত্রীদের একাংশকে তুলোধনা করার পরে শহর জুড়ে ফুটপাত দখলমুক্ত করতে ব্যাপক পুলিশি তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। দোকানের বাড়তি অংশ ভাঙানো বা প্লাস্টিকের ছাউনি খুলিয়ে ফেলতেও দেখা যাচ্ছে থানার অফিসারদের। এই পরিস্থিতিতেই বুধবার শহরের নানা প্রান্ত ঘুরে দেখা গেল, পুলিশের তাড়া খেয়ে হকারদের বড় অংশই এখন ফুটপাতে বসার জন্য আর্থিক লেনদেনের প্রসঙ্গ তুলছেন। কোথায় বসতে কাকে, কত টাকা দিতে হয়েছে, সেই সব হিসাব দিয়ে তাঁদের প্রশ্ন, ‘‘শহরের এই হকার-চিত্র কি নতুন? কেন টাকার বিনিময়ে পাকাপাকি ছাউনি বানিয়ে দেওয়া হল?’’
এ দিন কালীঘাট মেট্রো স্টেশন সংলগ্ন ফুটপাত থেকে গড়িয়াহাট মোড় পর্যন্ত হাঁটার পথে সানি মালি নামে এক দোকানদার বললেন, ‘‘রোল-চাউমিনের স্টল দিতে মাসে সাত হাজার টাকা ভাড়া দিচ্ছি।’’ ওই পথেই হকার স্বপন রায়ের দাবি, ‘‘মাথার উপরে টিনের ছাউনি পেতে ১০ হাজার ৪০০ টাকা করে আমাদের স্টল-পিছু দিতে হয়েছে। আলো ও পাখার খরচ যথাক্রমে ৩০ আর ৫০ টাকা।’’ কিছুটা এগোতেই গড়িয়াহাটের এক বিক্রেতার আবার মন্তব্য, ‘‘২৬০ টাকা প্রতি বর্গফুট হিসাবে এখানে ফুটপাতে বসার জায়গা দেওয়া হয়েছে। মাথার উপরে টিনের ছাউনি দিয়ে আলাদা করে আরও সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা দিতে হয়েছে স্থানীয় নেতার অফিসে।’’ অবস্থা কিছু মাত্র আলাদা নয় নিউ মার্কেট চত্বরেও। সেখানে ফুটপাতের প্রতি বর্গফুটের জন্য কোথাও ২৭০, কোথাও ৩০০ টাকা করে নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ।
হাতিবাগানে আবার বছর দুয়েক আগেই দেড় লক্ষ টাকার বিনিময়ে ফুটপাত বিক্রির অভিযোগ উঠেছিল। কাশীপুরের রতনবাবু রোডের বাসিন্দা মণিকা জানা সরাসরি ‘টক টু মেয়র’ অনুষ্ঠানে এ কথা জানিয়েছিলেন। ফুটপাত কেনার স্ট্যাম্প পেপার-ও সামনে আনেন তিনি। নিমাই সাহা নামে ওই এলাকার এক হকার বললেন, ‘‘এ জিনিস এখনও সমান ভাবে চলছে। প্রতিদিনের দোকান পাতার জন্য ২০০ টাকা করে তোলা দিতে হয়। এর মধ্যেই নেতা-দাদারা টাকা নিয়ে দোকান হাতবদল করান। জায়গা বিক্রিও হয় মোটা দামে!’’
কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম অবশ্য বললেন, ‘‘কে, কার থেকে টাকা নিয়েছে, বলতে পারব না। অভিযোগ থাকলে পুলিশে যেতে বলুন।’’
ফুটপাত বিক্রির কথা সামনে আনা সেই মণিকা এ দিন বললেন, ‘‘পুলিশ তো দূর, টক টু মেয়র অনুষ্ঠানে সরাসরি জানিয়েও তো লাভ হয়নি। কিন্তু এখন আমি খুব খুশি। এ বার ওরা ফুটপাত বিক্রি করে টাকা কামানোর ফল ভুগবে।’’
(চলবে)