সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: ডাকাতির পর একটিও ‘ক্লু’ অর্থাৎ সূত্র ছেড়ে যায়নি দুষ্কৃতীরা। ভরা ভোটের মরশুমে পুরুলিয়ার নদিয়াড়ায় ডাকাতির ঘটনার তদন্তভার হাতে পেয়ে কিনারা করতে নাকানিচোবানি খেতে হয়েছিল দুঁদে পুলিশ কর্তাদের। কিন্তু ওই, কথায় আছে ? অপরাধ সংঘটিত করার পর অপরাধী কোনও না কোনও ক্লু ঠিক ফেলেই যাবে অকুস্থলে, যা তাদের ধরিয়ে দেবেই দেবে। এখানেই ঠিক তেমনই হল। ঘটনাস্থলের অদূরে ডাকাতদের ফেলে যাওয়া দুটি মদের বোতল ছিল সেই ক্লু। যার গায়ে থাকা কিউআর কোড (QR Code) স্ক্যান করে, প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে দেড় মাসের মাথায় তার কিনারা করে ফেলল পুরুলিয়া জেলা পুলিশ। ৬ জনকে গ্রেপ্তার করে তোলা হয় রঘুনাথপুর আদালতে। তাদের ১২ দিনের পুলিশ হেফাজতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
গত ৯ মে পুরুলিয়ার নদিয়াড়া গ্রামে এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে নগদ, গয়না মিলিয়ে প্রায় ৩৫ লক্ষ টাকা ডাকাতি হয়। ডাকাতদল সিসিটিভির ডিভিআর পর্যন্ত নিয়ে চলে যায়। এই ঘটনার তদন্তে নেমে কোনও সূত্র খুঁজে পাচ্ছিল না পুলিশ। লোকসভা ভোটের মাঝে এমন অপরাধের ঘটনার কিনারা করতে বিশেষ তদন্তকারী দল (SIT) গঠন করে পুরুলিয়ার পুলিশ। DSP পদমর্যাদার এক অফিসারকে মাথায় রেখে পুলিশ সুপারের নেতৃত্ব তৈরি হয় বিশেষ টিম। ছিলেন Special Operation Group-এর সদস্যরাও। নদিয়াড়া গ্রামের অদূরে অর্থাৎ ঘটনাস্থল থেকে কিছুটা দূরে ব্র্যান্ডেড দুটি মদের বোতল উদ্ধার হয়। তাতে কিউআর কোড ছিল। দুঁদে তদন্তকারীরা সেই কিউআর কোডকে হাতিয়ার করেই তদন্তে নামেন।
সিটের প্রধান পুলিশ সুপার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে পুরো অপারেশনটি হয়। মদের বোতলের কিউআর কোড স্ক্যান করে কিছু সংখ্যা পাওয়া যায়। সেই সংখ্যা খতিয়ে দেখে কোথা থেকে মদের বোতলগুলি বিক্রি হয়েছে, তা বোঝা যায়। এর পর জেলা আবগারি দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করে SIT। মদ সরবরাহকারীর খোঁজ শুরু হয়। ডিসট্রিবিউটরের তরফে কোন অফ শপে ওই মদের বোতল পৌঁছেছে। তাতে জানা যায়, পুরুলিয়ার মফস্বল থানার চাষমোড়ের দোকানে দুটি মদের বোতল বিক্রির জন্য আসে। কবে বিক্রি হয়েছিল, সেসব তথ্য সংগ্রহ করেন তদন্তকারীরা। জোগাড় করা হয় ওই দোকানের সিসিটিভি ফুটেজও। তা দেখে ক্রেতা তথা দুষ্কৃতীদের চিহ্নিত করা হয়। প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে আরও বেশ কিছু তথ্য হাতে পায়। সেসবের সূত্র ধরেই নদিয়াড়ায় ডাকাতির ঘটনার কিনারা হয়।
মঙ্গলবার গ্রেপ্তার করা হয় ঝাড়খণ্ডের (Jharkhand) তিন বাসিন্দা সরবতি আনসারি, মইমুদ্দিন আনসারি, কায়ুম আনসারিকে। এর মধ্যে মইমুদ্দিন ও কায়ুমের বাড়ি ধানবাদের কাতরাসের শ্যামডিতে। সরবতি ঝাড়খণ্ডের রেহেরগোড়ার বাসিন্দা। ধৃত বাকি তিনজনের নাম দিলখুশ আনসারি, সাকিমুদ্দিন আনসারি, নইম আনসারি। তাদের সকলের বাড়ি পুরুলিয়ার (Purulia) সাঁওতালডিহির পারবহাল গ্রামে। ধৃতদের কাছ থেকে ৬ রাউন্ড গুলি, ৬টি পাইপগান উদ্ধার করেছে পুলিশ। বুধবার রঘুনাথপুর আদালতে তাদের পেশ করা হলে ১২ দিন পুলিশ হেফাজতের নির্দেশ দেন বিচারক। পুরুলিয়ার পুলিশ সুপার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “গত মে মাসে এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে ডাকাতির ঘটনায় কোনও সূত্র ছিল না। তার মধ্যেই ওই ঘটনায় আগ্নেয়াস্ত্র সমেত ৬ জনকে গ্রেপ্তার করে ওই ডাকাতি-সহ মোট চারটি ঘটনার কিনারা হয়েছে।”
উল্লেখ্য, এই ডাকাতদলকে (Dacoits) গ্রেপ্তারের পর আরও যে তিনটি ঘটনার কিনারা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে ২০২২ সালের একটি ঘটনাও। সেবার রঘুনাথপুরের তাঁতিপাড়ায় ব্যবসায়ীর বাড়িতে ভয়াবহ ছিনতাই হয়েছিল। চলতি বছর আদ্রার সুভাষনগরের রেল কলোনি এবং আড়শার সোনাবনা গ্রামে গৃহস্থ বাড়িতে ডাকাতির ঘটনার নেপথ্যেও ছিল এই দুষ্কতীদলের হাত। বৃহস্পতিবার সমস্ত বিষয়টি প্রকাশ্যে এনেছে জেলা পুলিশ।