কেন মমতা ওই নির্দেশ দিয়েছিলেন, তা বোঝার জন্য ফেলু মিত্তির হওয়ার প্রয়োজন নেই। লোকসভা ভোটে শহুরে ভোটে কার্যত ধস নেমেছে তৃণমূলের। গ্রামের ভোটে ভাল ফল করলেও কলকাতা-সহ শহরাঞ্চলের ভোটের ফলাফল তৃণমূলের পক্ষে আদৌ ‘স্বস্তিজনক’ নয়। গোটা রাজ্যে ১২১টি পুরসভার মধ্যে ৬৯টিতেই পিছিয়ে রয়েছে তৃণমূল। পোড়খাওয়া রাজনীতিক মমতা বুঝেছিলেন, তাঁর সরকারের উপরে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার ছায়া পড়তে শুরু করেছে। কিন্তু শুধুমাত্র ফুটপাথ দখল হয়ে যাওয়া ওই বিরোধিতার কারণ নয়। দলের এক বিধায়কের বরং পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘ফুটপাথ তো বহু দিনই দখল হয়েছে। তা হলে ২০২১ সালে শহরের মানুষ আমাদের ভোট দিলেন কেন?’’ তাঁর প্রশ্নের যে জবাব দলের একাংশ দিচ্ছেন, তা শাসক শিবিরের পক্ষে খুব সুখের নয়। কারণ, দলের অন্দরেও এমন রিপোর্ট এসেছে যে, গ্রামে প্রভাব না পড়লেও পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বান্ধবীর বাড়িতে টাকার পাহাড়ের ছবি বা নিয়োগ দুর্নীতির মতো ঘটনায় শহরাঞ্চলে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা তৈরি হয়েছে। সেই কারণে শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ শাসকদলের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। যা ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটে বেশ কিছু আসনে প্রভাব ফেলতে পারে। উল্লেখ্য, প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার হাওয়া সর্বপ্রথম শহরেই দেখা যায়। ‘জনমত’ তৈরিতে শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভূমিকাও ফেলে দেওয়ার মতো নয়।
সেই সব দিক বিবেচনা করেই মমতা তড়িঘড়ি শহরাঞ্চলে ‘সংস্কার’ করার দিকে মনোযোগ দিয়েছিলেন। তার মধ্যে যেমন ছিল কলকাতা, নিউ টাউন, বিধাননগরের মতো পুর এলাকা, তেমনই ছিল রাজ্যের বিভিন্ন জেলাসদরও। ‘বেআইনি দখলদার’ উচ্ছেদ করতে কঠোর নির্দেশ জারি করেছিলেন মমতা। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ পেয়ে মনের সুখে ‘দখলদার’ উচ্ছেদ করতে শুরু করেছিল পুলিশ-প্রশাসন। কিন্তু তা করতে গিয়ে হকারদের একাংশকে বিপন্নও করে ফেলেছিল তারা। দক্ষিণ কলকাতার এক তৃণমূল নেতার বক্তব্য, ‘‘বহু জায়গায় দলের কাউন্সিলর এবং প্রশাসনের একাংশের বোঝাপড়ায় যে তোলাবাজি চলছে, তা বাস্তব। কিন্তু এটাও সত্যি যে, দীর্ঘ দিন ধরে ফুটপাথে দোকান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ-করা মানুষের উপরেও আঘাত এসে পড়ছে। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের পরে পুলিশ কোথাও কোথাও রোবটের মতো কাজ করছে। তা-ও মুখ্যমন্ত্রীর কানে গিয়েছে।’’
মঙ্গল এবং বুধবার থেকে সেই বিপন্নতার টুকরো টুকরো ছবি প্রকাশিত হতে থাকে। উচ্ছেদের পরে অনেককেই প্রকাশ্যে চোখের জল ফেলতে দেখা যায়। পাশাপাশি, ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিবৃতি দিতে শুরু করে হকারদের সংগঠনগুলি। কোনও কোনও মহল থেকে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে এই বার্তাও পৌঁছে দেওয়া হয় যে, এই কঠোর সিদ্ধান্তের ফলে কোনও হকার বা তাঁর পরিবারের কেউ কোনও ‘হঠকারী’ সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলে তার দায় এসে পড়বে সরকারের উপর। তার পরেই মুখ্যমন্ত্রী ঠিক করেন, বৃহস্পতিবার তিনি আবার একটি বৈঠক ডাকবেন। সেখানেই ওই অভিযানের উপর সাময়িক ‘রাশ’ টানা হবে।
তবে তাঁর সরকারের ‘সদিচ্ছা’ প্রমাণে অভিযান বাতিলের কথা ঘোষণা করেননি মমতা। তিনি বলেছেন, আপাতত এক মাস ওই উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ থাকবে। তার মধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর গড়ে-দেওয়া পাঁচ সদস্যের কমিটি একটি সমীক্ষা করে রিপোর্ট দেবে। এক মাস পরে তিনি আবার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করবেন। প্রসঙ্গত, প্রশাসনের অনেকেই মনে করেন, কোনও বিষয়কে সাময়িক ভাবে ‘ধামাচাপা’ দেওয়ার প্রকৃষ্টতম উপায় হল একটি কমিটি গড়ে দেওয়া। এখন দেখার, এক মাস পরে ওই কমিটি কী রিপোর্ট দেয় এবং সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে মমতা কী সিদ্ধান্ত নেন।
তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেতার দাবি, শহরাঞ্চলে ভোটে হারের কারণ শুধু ফুটপাথ দখল নয়। আরও বিবিধ বিষয় রয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘শহুরে উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্তের ভোট তৃণমূল পায়নি ঠিকই। কিন্তু শহরে বুথওয়াড়ি ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, বস্তিবাসী গরিব মানুষ আমাদেরই ভোট দিয়েছেন। ফুটপাথ দখলমুক্ত করতে গিয়ে অর্থনৈতিক ভাবে সেই গরিব মানুষের রুটিরুজির উপরেই আঘাত নামছে। মুখ্যমন্ত্রী সম্ভবত তা বুঝেই এক পা পিছিয়ে আসার কৌশল নিয়েছেন।’’
কলকাতার এক কাউন্সিলরের বক্তব্য, ‘‘যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটা সময়ে অপারেশন সানশাইনের বিরোধিতা করেছিলেন, সেই তিনি যদি এখন হকারদের তুলে দিয়ে তাঁদের রুজিতে হাত দেন, তা হলে তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। তিনি সম্ভবত সেটা বুঝেছেন।’’
ওই অভিযানের ঘোষণা করতে গিয়ে মমতা এক শ্রেণির কাউন্সিলরের কথাও বলেছেন। দরকারে সেই সব ‘অসাধু’ কাউন্সিলরকে গ্রেফতার করা হবে বলেও জানিয়ে দিয়েছেন। শাসক শিবিরের একাংশের বক্তব্য, ওই ঘোষণা মারফত তিনি এই বার্তাই দিতে চেয়েছেন যে, তিনি প্রশাসনের থেকে দলকে বিচ্ছিন্ন করে দেখছেন। যাতে দলের ‘দায়’ সরকারের উপর এসে না-পড়ে। দলের ‘বেনোজল’ দূর করতে হবে। যেমন নবান্নের বৈঠকে তিনি প্রকাশ্যেই ফিরহাদ হাকিম, দেবাশিস কুমারদের ভর্ৎসনা করে বলেছেন, ‘‘তোমার পারছ না বলেই তো আমায় ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে!’’
দ্বিতীয় যে অভিমতের কথা শোনা যাচ্ছে, তা হল, তাঁর রাজনৈতিক বিরোধীদের ‘অপ্রাসঙ্গিক’ করে দিয়ে মমতা নিজেই বিরোধী পরিসরটি নিয়ে নিয়েছেন। যে অভিযোগগুলি বিরোধীরা তাঁর সরকার এবং দলের বিরুদ্ধে তুলত, তিনি নিজেই সেগুলি তুলছেন। প্রকাশ্যে।
তৃণমূলের অন্দরে এমন বক্তব্যও রয়েছে যে, রাজ্য সরকার সময় দিলে এই প্রতিক্রিয়া তৈরি হত না। এক নেতার কথায়, ‘‘হঠাৎ করে কেউ যদি এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হন, তা হলে তো তিনি পরিবার নিয়ে বিপদে পড়বেন! এই দিকটাও ভেবে দেখা উচিত ছিল।’’ তৃণমূলের এক জেলা সভাপতির বক্তব্য, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী থাকাকলীন মমতাদি রেলের হকার উচ্ছেদ রুখে দিয়েছিলেন। লাইনের ধারে বসতি করে থাকা মানুষকে আরপিএফ তুলতে গেলে তারও প্রতিবাদ করেছেন। কিন্তু গত ৭২ ঘণ্টায় তাঁর সেই উচ্ছেদ-বিরোধী ভাবমূর্তি প্রশ্নের মুখে পড়ে যাচ্ছিল।’’
ফুটপাথ ‘দখলমুক্ত’ করার কথা বলতে গিয়ে মমতা দু’টি বৈঠকেই বলেছেন বাংলার ‘আইডেন্টিটি’ নষ্ট হচ্ছে। তাঁর কথায়, ‘‘এর পর তো বাংলায় কথা বলার লোকও পাওয়া যাবে না।’’ অর্থাৎ, কলকাতা ও শহরতলিতে হিন্দিভাষীদের দাপট দেখা যাচ্ছে। বাঙালিরা ‘বিপন্ন’ হয়ে পড়ছেন। ওই হিন্দিভাষীদের বড় অংশ বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন বলে তৃণমূলের প্রথম সারির নেতারা মনে করেন। কিন্তু অভিযান শুরু হওয়ার পর দেখা গিয়েছে, বেহালায় বুলডোজ়ার চললেও বড়বাজারের ফুটপাথ দখলমুক্ত করা হচ্ছে না।
এই সমস্ত দিক বিবেচনা করেই কুশলী রাজনীতিক মমতা আপাতত এক পা পিছিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে অভিযান শুরুর ৭২ ঘণ্টা পরে তা স্থগিত করে দেওয়ার ‘নেতিবাচক’ প্রভাব তৈরি হতে পারে। সমস্ত দিক বিবেচনা করে মমতা ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এখন দেখার, শহরের ভোট ফেরাবার তাগিদে তিনি শেষ পর্যন্ত যাবেন? না কি বিবিধ অঙ্ক কষে আরও পিছিয়ে যাবেন?