এই সময়: হকার-সমস্যার সমাধান যেমন বুলডোজ়ার নয়, তেমনই ফুটপাথ দখল করে ব্যবসাও কোনও কাজের কথা নয় বলেই মনে করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফুটপাথে জবরদখল সরিয়েও হকারদের রুটি-রুজি অক্ষুণ্ণ রেখে কী ভাবে সমস্যার সমাধান করা যায়, বৃহস্পতিবার নবান্নের বৈঠকে তার রূপরেখাও দিয়েছেন সিএম। তাঁর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের একটি বড় দায়িত্ব বর্তেছে হকারদের উপরেই।মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, ব্যবসা করতে হবে নিয়ম মেনে। কারও অসুবিধে করে নয়। রাস্তা এবং ফুটপাথ ফাঁকা রাখার দায়িত্ব নেবেন হকাররা। এ জন্য একমাস সময়ও বেঁধে দিয়েছেন তিনি। হকার-উচ্ছেদ অভিযানে সাময়িক বিরতি ঘোষণা করে এ দিন নবান্নে বিভিন্ন হকার সংগঠনের প্রতিনিধি এবং পুলিশকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘হকারদের রুটি-রুজি রক্ষা করে যা করার করতে হবে। স্বচ্ছতা বজায় রাখতে হবে, আবার জীবন-জীবিকাও রক্ষা করতে হবে। আমি চাই, হকাররা নিয়ম মেনে ব্যবসা করুন। যাতে অন্যের অসুবিধে না হয়।’
তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, ফুটপাথ দিয়ে সাধারণ মানুষ যাতে ঠিক ভাবে চলাচল করতে পারেন এবং আশপাশের দোকানের জন্য যাতে তাঁদের কোনও অসুবিধে না হয়, তা সুনিশ্চিত করতে হবে হকারদেরই। স্থানীয় ভাবে হকাররা নিজেদের উদ্যোগে রাস্তা ও ফুটপাথ ক্লিয়ার করবেন। তাঁরা কোথায় বসতে পারবেন, তা চিহ্নিত করতে হকিং জো়ন তৈরি হবে বলে জানিয়েছেন মমতা। হকার সমস্যা মেটাতে এর আগে যে ‘টাউন ভেন্ডিং কমিটি’ তৈরি হয়েছিল, তা ভেঙে নতুন কমিটি গড়ার নির্দেশও দিয়েছেন তিনি।
গত সোমবার নবান্নে পুর-পরিষেবা সংক্রান্ত প্রশাসনিক বৈঠকে টাকার বিনিময়ে ফুটপাথে হকার বসানোর অভিযোগ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর ক্ষোভের আঁচ পেয়ে সোমবার রাত থেকেই কলকাতা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে হকার উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে পুলিশ-প্রশাসন। বৃহস্পতিবার সকালেও সেই অভিযান অব্যাহত ছিল। ফলে হকারদের একটি বড় অংশ অনিশ্চয়তার মুখে দাঁড়ান।
আবার জবরদখল থেকে ফুটপাথ মুক্ত করাও প্রয়োজন। এই দুই বাস্তবের মধ্যে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাসবাণীতে হকাররা যেমন নিশ্চিন্ত হলেন, তেমনই ফুটপাথ এবং রাস্তা পরিষ্কার রাখার দিশাও মিলল। মমতার আহ্বানে সাড়া দিয়ে হকার সংগঠনের নেতারা কথা দিয়েছেন, তাঁরা নিয়ম মেনে ব্যবসা করবেন। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ, হকাররা এখন থেকে ফুটপাথের উপরে কোনও মালপত্র মজুত করতে পারবেন না।
তবে সমাধানও দিয়েছেন তিনি। মালপত্র মজুতের জন্য সরকার গোডাউন বানিয়ে দেবে। তৈরি হবে হকার মার্কেটও। মুখ্যমন্ত্রী এ দিন সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, নতুন করে আর কাউকে ফুটপাথে বসতে দেওয়া হবে না। হকারি করার জন্য নির্দিষ্ট জ়োন থাকবে। কলকাতা এবং রাজ্যের অন্য শহরে এমন অনেক হকার রয়েছেন যাঁরা চার-পাঁচটা ডালার (যেখানে বসে হকাররা ব্যবসা করেন) মালিক। এখন থেকে আর সেটা হবে না। হকাররা খেয়ালখুশি মতো যত্রতত্র বসতে পারবেন না। যাঁদের সরানো হবে, তাঁদের জন্য বিকল্প জায়গা করে দেবে সরকার।
ধর্মতলার গ্র্যান্ড হোটেলের প্রসঙ্গ টেনে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘গ্র্যান্ডে অনেক হাইপ্রোফাইল মানুষ যান। তাই সেখানে হকার অ্যালাও করলে মুশকিল। যদি কোনও ঘটনা ঘটে, তখন তো আবার সিকিউরিটি নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। অন্য কেউ কিছু একটা ঘটিয়ে আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে পারে। সেই সুযোগ কেন দেবো? যদি কেউ বলেন আমি গ্র্যান্ডের পাশেই বসব, তা হবে না।’
হকারদের বসার জায়গা খুঁজতে হাতিবাগান, গ্র্যান্ড হোটেল চত্বর, নিউ মার্কেট এবং কলকাতা পুরসভার সামনে নতুন করে সমীক্ষা করতে বলেছেন মমতা। হকারদের বসার জায়গা ঠিক করতে পুরমন্ত্রী তথা কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম, মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, কলকাতার ডেপুটি মেয়র অতীন ঘোষ, মেয়র পারিষদ দেবব্রত মজুমদার এবং দেবাশিস কুমারকে দায়িত্ব দিয়েছেন তিনি।
রাজ্যের অর্থনীতিতে হকারদের ভূমিকা স্মরণ করিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘হকারিটাও একটা ব্যবসা। অর্থনীতিতে হকারদেরও ভূমিকা রয়েছে। দোকানে যে জিনিসের দাম পাঁচ হাজার টাকা, সেটাই হকারদের কাছে পাঁচশো টাকায় পাওয়া যায়। হকাররা যে সব জিনিস বিক্রি করেন, সেগুলো লোকাল ব্র্যান্ড। কিন্তু সেটাই সবথেকে দামি ব্র্যান্ড।’
মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, ‘দোকানদারকেও ভালো রাখতে হবে, আবার এঁদেরও (হকারদের) ভালো রাখতে হবে। কারও চাকরি খেয়ে নেওয়ার অধিকার আমার নেই।’ হকার সংগ্রাম কমিটির সম্পাদক শক্তিমান ঘোষ বলেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে হকারদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, তাতে তাঁকে আমরা সাধুবাদ জানাচ্ছি। আমরাও চাই সকলে নিয়ম মেনে ব্যবসা করুন। শহর সুন্দর রাখার দায়িত্ব তো আমাদেরও।’