বাসভাড়া নেই নাকি বাল্যবিবাহ, সমস্যা শুনে মুশকিল আসান স্কুল শিক্ষকেরা
এই সময় | ২৮ জুন ২০২৪
সমীর মণ্ডল, মেদিনীপুর
স্কুলছুট পড়ুয়াদের সমস্যা বুঝতে দুয়ারে হাজির খোদ স্কুলশিক্ষকরা। শুধু সমস্যার কথা শোনাই নয়, সাধ্যমতো সমাধানের চেষ্টাও করেছেন তাঁরা। রুখেছেন এক নাবালিকা ছাত্রীর বিয়ে। বোঝানোর চেষ্টা করেছেন এক পড়ুয়ার মদ্যপ অভিভাবককেও। এমনকী, দুঃস্থ পরিবারের পড়ুয়াদের যাতায়াতের ব্যবস্থাও করেছেন তাঁরা।পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনি ব্লকের মৌপাল দেশপ্রাণ বিদ্যাপীঠের ঘটনা। একজন পড়ুয়াও যাতে স্কুলছুট না হয়, সেজন্য এই উদ্যোগ বলে জানিয়েছেন শিক্ষকরা। স্কুলে গরমের ছুটি পড়ার আগেই সার্ভে করে অনিয়মিত পড়ুয়াদের তালিকা তৈরি করা হয়েছিল। স্কুল খোলার পরে ২৫ জন শিক্ষক, ৫ জন শিক্ষাকর্মী ৬টি দলে ভাগ হয়ে প্রায় কুড়িটি গ্রামে ঘুরে বেড়িয়েছেন। স্কুলে ২৫ শতাংশেরও কম উপস্থিতি যাদের, বেছে বেছে সেই পড়ুয়াদের বাড়ি যাওয়া হয়। দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে গিয়ে বেরিয়ে আসে হেঁশেলের খবর।
গরমের ছুটির মধ্যে এক নাবালিকার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছিল তার পরিবার। এমন খবর জানতে পেরে প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন শিক্ষকরা। বিয়ে আটকে ওই নাবালিকাকে স্কুলে আনার ব্যবস্থা করেছেন তাঁরা। প্রশাসনের সহযোগিতায় অভিভাবককে দিয়ে মুচলেকাও লেখানো হয়েছে, এখনই মেয়ের বিয়ে দেবেন না তাঁরা। তবে শুধু বাল্যবিবাহ নয়, বাড়ি বাড়ি ঘুরতে গিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে এই শিক্ষকদের।
স্কুলে না আসার কারণ জানতে চাইলে এক ছাত্রী তাঁদের বলে, ‘কী করে স্কুলে যাব! বাড়িতে বাবা নেশা করে এসে প্রচন্ড অশান্তি করেন। তাই মা বাড়ি ছেড়ে আমাকে নিয়ে মামাবাড়ি চলে এসেছে। সে জন্য স্কুলে যেতে পারি না।’ তার বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলেছেন শিক্ষকরা। বুঝিয়েছেন, বাড়িতে যেন পড়াশোনার উপযুক্ত পরিবেশ থাকে! তবেই তো স্বপ্ন সফল করার পথে দু’কদম এগিয়ে যেতে পারবে মেয়ে।
কয়েক জন আবার জানিয়েছে যাতায়াতের সমস্যার কথা। নবম শ্রেণিতে উঠলে ‘সবুজসাথী’ সাইকেল মিলবে। কিন্তু তার আগে কী হবে? সে সব ছাত্রের যাতায়াতের জন্য সাইকেলের ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নিয়েছেন শিক্ষকেরা। কিছু পড়ুয়া জানিয়েছে, বাসভাড়া দেওয়ার ক্ষমতা নেই পরিবারের। স্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রসূন পড়িয়া বলেন, ‘দুঃস্থ ছাত্রছাত্রীরা যাতে ফ্রি-তে যাতায়াত করতে পারে, তা নিয়ে বাস মালিক সংগঠনের সঙ্গে স্কুল কর্তৃপক্ষের আলোচনা হয়েছে। ওরা শুধু স্কুলে আসুক, বাকি সমস্যার সমাধান আমরা খুঁজে বের করব।’
যশপুরের আকাশ কালিন্দী আবার জানিয়েছে, স্কুল থেকে সব বই দিলেও রেফারেন্স বই কেনার পয়সা নেই তার। তাকে এবং তার মতোই কয়েক জনকে বই কিনে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন স্কুলের শিক্ষক কল্যাণ ভট্টাচার্য, লক্ষ্মীকান্ত ভুঁইয়া, ডলি দণ্ডপাট জানা, তারকনাথ দাসরা। বেতকুন্দরীর উমা সিংয়ের জন্ডিস। তাকে প্রয়োজনীয় উপদেশ দিয়েছেন শিক্ষকেরা। বাগমারির তুফান কোটালের বাবা দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। ফলে স্কুল বন্ধ হয়েছে ছেলের। শিক্ষকেরা তাকে গাইড করছেন, যাতে পড়াশোনা বন্ধ না হয়।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রসূন পড়িয়া বলেন, ‘দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে বুঝতে পারলাম, পড়ুয়াদের অনীহার পাশাপাশি অভিভাবকদের সচেতনতার অভাবও স্কুলছুট হওয়ার কারণ। বছরে একবার নয়, সারা বছরই এ বিষয়ে নজর রাখা হবে। ১৫ দিন অন্তর পর্যালোচনা মিটিং করা হবে। প্রয়োজনে আবার ওই ছাত্রছাত্রীদের বাড়িতে যাবেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা। ছাত্রছাত্রীদের বাসভাড়া, সাইকেল ও বইপত্রের যে সমস্যার কথা উঠে এসেছিল, সে ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’