শহরের ফুটপাত জবরদখল করে বসা হকারদের সরাতে নেমে রাজ্য সরকারের সামনে এখন এমনই পরিস্থিতি বলে মত হকার ইউনিয়নের নেতা থেকে প্রশাসনিক কর্তাদের। দেখা যাচ্ছে, জবরদখল হয়ে থাকলেও কাউকেই অবৈধ ঘোষণা করার উপায় নেই। উল্টে ‘হকিং জ়োন’ আর ‘নন-হকিং জ়োন’ ভাগ করে পর্যাপ্ত জায়গা দিতে না পারায় এক জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এরই মধ্যে উচ্ছেদে নেমে নানা মহলের কড়া প্রতিক্রিয়ায় অনেকটাই নমনীয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বৃহস্পতিবার নবান্নে আরও একটি বৈঠক করে বলেন, ‘‘আমি হকার উচ্ছেদের পক্ষে নই। কারও চাকরি খাওয়ার, কাউকে বেকার করে দেওয়ার অধিকার আমার নেই।’’ সেই সঙ্গেই তিনি স্থানীয় হকার নেতাদের সতর্ক করে বলেন, ‘‘হকার নেতারা চাঁদা তুলবেন না। নেতারা লোভ সংবরণ করুন।’’ হকার কমিটির সদস্য তথা টাউন ভেন্ডিং কমিটির কর্তারা এই পরিস্থিতিতে বলছেন, ‘‘প্রশাসনের দায়সারা মনোভাবেই এই অবস্থা। বছর বছর সমীক্ষা হলেও শংসাপত্র দেওয়ার কাজ শেষ হয়নি। উল্টে স্থায়ী ছাউনি বানিয়ে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।’’
২০১৫ সালে মুখ্যমন্ত্রী হকারদের বৈধতা দেওয়ার পাশাপাশি রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট (শংসাপত্র) দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। প্রায় ৬১ হাজার আবেদনপত্র জমা পড়ে। তার মধ্যে ৫৯ হাজার আবেদনপত্র গ্রহণযোগ্য ছিল বলে এ দিনও জানান মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু ন’বছরেও হকার শংসাপত্র (ভেন্ডিং সার্টিফিকেট) দেওয়ার কাজ শেষ হয়নি। উল্টে ফের ২০২২ সালে শহরের বড় তিনটি বাজারে হকার সমীক্ষার পাইলট প্রকল্প নেওয়া হয়। বলা হয়, ফুটপাত মেপে এক-তৃতীয়াংশ জায়গা হকারদের জন্য রেখে বাকিটা দখলমুক্ত করা হবে। তার পরেই শেষ করা হবে শংসাপত্র দেওয়ার কাজ। কিন্তু সমীক্ষা শেষ হতে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি পেরিয়ে যায়। শেষে গড়িয়াহাট থেকে প্রায় ২৪০০ জন, হাতিবাগান এবং নিউ মার্কেট থেকে যথাক্রমে ১৪০০ ও ২০০০ জন হকারের নাম নথিভুক্ত হয়। ঠিক হয়, ২০১৫ সালের সরকারি নির্দেশ মতো যে হকারেরা শংসাপত্রের আবেদন করেছিলেন, তাঁদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
কিন্তু দেখা যায়, গড়িয়াহাটে বর্তমানে নথিভুক্ত ২৪০০ জনের মধ্যে মাত্র ছ’জনের পুরনো আবেদনের কাগজ আছে। হাতিবাগান-শ্যামবাজারের ১৪০০ জনের মধ্যে কাগজ আছে ১০ জনের। নিউ মার্কেটেও নথিভুক্ত ২০০০ জনের মধ্যে পুরনো কাগজ রয়েছে ছ’জনের। অর্থাৎ, শুধু ২২ জন হকারের থেকে পুরনো কাগজ মেলে। কাকে আগে শংসাপত্র দেওয়া হবে, সেই জটিলতার মধ্যেই টালবাহানা শুরু হয় শংসাপত্রের ফি নিয়ে। টাউন ভেন্ডিং কমিটিতে সিদ্ধান্ত হয়, হকার-পিছু দিতে হবে ৫০০ টাকা। প্রতি বছর শংসাপত্র নবীকরণে নেওয়া হবে ৫০০ টাকা। এ ছাড়া, ব্যবসার জন্য প্রতি বছর প্রত্যেক হকার পুরসভাকে দেবেন ২০০০ টাকা। অর্থাৎ, বছরে ২৫০০ টাকা। কিন্তু দীর্ঘ টালবাহানা কাটিয়ে মুখ্যমন্ত্রী নির্দেশ দেন, শংসাপত্র নবীকরণ বাবদ ৩০০ টাকা এবং হকার ট্যাক্স বাবদ ৫০০ টাকা, অর্থাৎ প্রতি বছর মোট ৮০০ টাকার বেশি নেওয়া যাবে না। যদিও এর পরেও শংসাপত্র দেওয়ার কাজ শেষ করার বদলে হাতিবাগান, নিউ মার্কেট ও গড়িয়াহাটে সমীক্ষায় নাম ওঠা হকার-পিছু টিনের ছাউনি দেওয়া স্থায়ী বসার জায়গা দেওয়া হয়। ৫৯ হাজারের মধ্যে মাত্র এক হাজার জনকে শংসাপত্র দেওয়া হয়েছে বলে খবর। কিন্তু শহরের সমীক্ষা হওয়া তিনটি বড় বাজারে শংসাপত্র পেয়েছেন মাত্র ২২ জন।
‘হকার সংগ্রাম কমিটি’র সভাপতি তথা টাউন ভেন্ডিং কমিটির সদস্য শক্তিমান ঘোষের দাবি, ‘‘২০১৪ সালের পথ বিক্রেতা (জীবিকা সুরক্ষা ও পথ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ) আইন অনুযায়ী, শহরের আড়াই শতাংশ জনতা হকারি করবেন ধরে নিয়ে শহরের পরিকল্পনা করতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ, হকারের সংখ্যা শহরের মোট জনসংখ্যার আড়াই শতাংশ পেরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত কোনও হকারকেই অবৈধ বলা যাবে না। যার অর্থ, শংসাপত্র দিতে হবে সকলকেই।’’
তা হলে জটিলতা কাটবে কী ভাবে? মুখ্যমন্ত্রী এ দিন ফের একটি হকার সমীক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছেন। প্রশ্ন উঠেছে, আর কত সমীক্ষা হলে হকার সমস্যার সমাধান হবে? উত্তর অবশ্য মেলে না।
(চলবে)