• অভিযানের ‘ক্ষতিপূরণ’ পাকা ঘর! তাতেই কি বাড়বাড়ন্ত জবরদখলের
    আনন্দবাজার | ২৯ জুন ২০২৪
  • ‘বহ্বারম্ভে লঘু ক্রিয়া’!

    কলকাতার হকার জবরদখল রুখতে পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকা বছরের পর বছর এমনই বলে মত অনেকের। কিছু ঘটলেই সরকারের শীর্ষ স্তর থেকে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। পুলিশ, মন্ত্রী, আমলাদের ধমকে কড়া বার্তা আসে। এর পর দিন কয়েকের উচ্ছেদ-পর্বও চলে। তার পরে যে-কে-সেই! নমনীয় হয়ে এই প্রশাসনের শীর্ষ কর্তারাই ‘মানবিক’ বার্তা দেন। চলতে থাকে জবরদখলের ‘হকার রাজ’। বৃহস্পতিবারই নবান্ন থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘কাউকে বেকার করে দেওয়ার অধিকার আমার নেই’ বলে মন্তব্য করে কিছুটা নরম হওয়ার পরে হকারদের একাংশ বলছেন, ‘‘আমাদের এই ভাবে তুলতে পারবে? কাকে কত দিয়েছি, সব বলে দেব।’’

    সচেতন নাগরিকদের বক্তব্য, ভোটের আগে এবং পরে এমন হুঁশিয়ারি অতীতেও দেখা গিয়েছে। সমীক্ষা করা হয়েছে। তবে কাজ হয়নি। কখনও পুলিশ কড়া বার্তা পেয়ে ধরপাকড়, উচ্ছেদ চালিয়েছে। অভিযোগ, ফুটপাত দখলমুক্ত তো হয়ইনি, উল্টে হকারদের শান্ত করতে ‘সান্ত্বনা পুরস্কার’ হিসাবে মিলেছে ছাউনি দেওয়া পাকা ঘর! উত্তর কলকাতার এক হকার ইউনিয়নের নেতা আবার বললেন, ‘‘জোর করে তুলে দেওয়া হলে ভোটবাক্সে প্রভাব পড়বে। হকারের সংখ্যা যে হারে বাড়ছে, তাতে কেউই তাঁদের চটাতে চাইবেন না। কিন্তু মাঝেমধ্যে এমন উচ্ছেদ অভিযানের পরে পরিস্থিতি সামলাতে আমাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হয়।’’

    কী ক্ষতিপূরণ? টাউন ভেন্ডিং কমিটি সূত্রের খবর, হকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে গিয়ে সদস্যেরা দেখেছেন, শহরের হকারদের এক তৃতীয়াংশ পাকা ঘরে ব্যবসা করছেন। যা হকার সংজ্ঞার পরিপন্থী। অথচ এক কালে ফুটপাতে ডালা নিয়ে বসে ব্যবসা করতেন যাঁরা, স্থানীয় নেতা-দাদাদের তরফে তাঁদেরই পাকা ঘর করে দেওয়া হয়েছে। কারও কাছেই হকার শংসাপত্র নেই। বেলেঘাটার চাউলপট্টি রোডে এমনই কিছু নির্মাণ তৈরি হয়েছে খালের ধারে, সেচ দফতরের জমিতে। ইট, বালি, সিমেন্টের তৈরি সেই ঘরের কোনওটিতে টিনের ছাউনি দেওয়া, কোনওটির ছাদ ঢালাই করা হয়েছে। এমনই একটি ঘরে রেস্তরাঁ চালু হওয়ায় এক স্থানীয় বাসিন্দা বললেন, ‘‘খালের ধারে সেচের জমিতে এমন নির্মাণ বেআইনি। এক সময়ে ডালা পেতে সেখানে খাবার বিক্রি করতেন এক জন। তিনিই এক নেতাকে ধরে পাকা ঘর পেয়েছেন।’’ একই জিনিস বেলেঘাটা মেন রোডের দিকে যাওয়ার পথে খালের ধারে। সেখানে আবার পাকা ঘর তৈরি করে টিনের ছাউনি দিয়ে প্রতিটি ৭-৮ লক্ষ টাকায় বিক্রি হয়েছে বলে অভিযোগ।

    সূত্রের খবর, নারকেলডাঙা এবং বেলেঘাটা মেন রোডের উপরে এমন পাকা ঘর পাওয়া হকারদের আবার দিতে হয়েছে প্রতি বর্গফুটে পাঁচ হাজার টাকা। অর্থাৎ, একশো বর্গফুট ঘর পেতে পড়েছে পাঁচ লক্ষ টাকা। টালা পার্কের কাছে একটি ফুটপাত ঘিরে বিস্তর অভিযোগ সেখানকার প্রাতর্ভ্রমণকারীদের। ওই ফুটপাতে নির্দিষ্ট মাপে পর পর পাকা ঘর তৈরি হয়েছে। প্রতিটি বিক্রি হয়েছে স্টল হিসাবে। দাম ৩-৪ লক্ষ টাকা। ইএম বাইপাস লাগোয়া এক পুরপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে আবার অভিযোগ, কয়েক লক্ষ টাকার বিনিময়ে তিনি আনন্দপুর এলাকায় হকারদের এমনই পাকা ঘর দিয়েছেন।

    যদিও ১৯৮০ সালের কলকাতা পুর আইনের ৩৭১ নম্বর ধারা অনুযায়ী, রাস্তা ও ফুটপাতে বাধা সৃষ্টিকারী স্থায়ী বা অস্থায়ী যে কোনও কাঠামোয় নিষেধাজ্ঞা জারি এবং প্রয়োজনে তা ভেঙে দেওয়ার পূর্ণ ক্ষমতা পুর কমিশনারের রয়েছে। বছর পাঁচেক আগে ‘স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিয়োর’ ঘোষণা করে পুরসভা বলেছিল, ফুটপাত বা কোনও রাস্তায় জবরদখল দেখলে সংশ্লিষ্ট বরো ইঞ্জিনিয়ারকে পুলিশে অভিযোগ দায়ের করতে হবে। তা জানাতে হবে মেয়র, বরো চেয়ারপার্সন-সহ উচ্চ পর্যায়ে। উচ্ছেদের কাজটি যে হেতু করবে জঞ্জাল অপসারণ দফতর, তাই জানাতে হবে তাদেরও। অন্যথায় সংশ্লিষ্ট বরো ইঞ্জিনিয়ারের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ করা হবে।

    বাস্তবে কি তা হয়েছে? মেয়র ফিরহাদ হাকিম শুক্রবার বলেন, ‘‘পুরস্কার বা ক্ষতিপূরণের ব্যাপার নয়, হকারদের দিকটা দেখাও আমাদের দায়িত্ব। কাউকে উৎখাত না করে শহরের চেহারা ফেরাতে হবে।’’

  • Link to this news (আনন্দবাজার)