• বুদ্ধদেব গুহ পরের জন্মে বাঘ হতে চেয়েছিলেন !
    দৈনিক স্টেটসম্যান | ৩০ জুন ২০২৪
  • স্বপনকুমার মণ্ডল

    বছর তেরো আগের কথা। দার্জিলিং গভর্নমেন্ট কলেজ ছেড়ে তখন হুগলি মহসিন কলেজে পড়াই । অধ্যাপনায় পদোন্নতির জন্য কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিফ্রেসার্স কোর্সে (২০১১,নভেম্বর-ডিসেম্বর) জয়েন করি। সেখানেই অন্য অনেক কৃতী বাঙালির মতো একটি ক্লাসে কথাসাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ’র (১৯৩৬-২০২১) সঙ্গে সামনা-সামনি হওয়ার সুযোগ মেলে। ইতিপূর্বে তাঁর পরিচয় নানাভাবে যেটুকু পেয়েছিলাম,তাতে তাঁর প্রতি বাড়তি কোনও আগ্রহ ছিল না। কিন্তু পরখ করায় কৌতূহলী ছিলাম। তাঁর বহুমুখী প্রতিভার পরিচয় প্রকট না হলেও তখন তিনি বাংলা সাহিত্যে রীতিমতো ডাকাবুকো। তাঁর চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ডিগ্রি বাড়তি সমীহ আদায় করে। আবার প্রাক্তন রাজ্যপাল বীরেন জে শাহের প্রতি আজকাল-এ নিয়মিত কলামের খোঁচা অশালীন মনে হয়েছিল। রাজ্যপালের রূপার থালাবাসনে খাওয়া নিয়ে তাঁর আক্রমণাত্মক লেখায় প্রতিবাদের চেয়ে প্রতিশোধ জেগে উঠেছিল। মনে হয়েছিল, এভাবে তিনি না লিখলেই পারতেন।

    আসলে খাবার যাই হোক,পরিবেশনের সৌজন্যও কাম্য। তাঁর লেখার ধরনে সংবেদী সাহিত্যিকের অভাববোধ আমায় ভাবিয়ে তুলেছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য,বামফ্রন্ট সরকারের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সুবিদিত। অন্যদিকে বুদ্ধদেব গুহের মধ্যে যে সরল অকপট প্রকৃতি ছিল,তা সেদিন ক্লাসরুমেই পেয়েছিলাম । অবশ্য তাকে নির্ভেজাল সরলতা বলা যায় না। শুধু সততাতেই নয়, আত্মম্ভরিতাতেও লোকে সরল হয়ে থাকে। বনেদি আভিজাত্যে মোড়া ব্যক্তিত্বে বুদ্ধদেব গুহ ইতিমধ্যেই প্রকাশমুখর কৃতী বাঙালি। সাহিত্যে আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন । অথচ তা নিয়ে তাঁর অকপট স্বীকারোক্তি, সেটি পেয়েছেন তাঁর সাহিত্যের জন্য নয়,আনন্দবাজার গোষ্ঠীর টাকা বাঁচানোর পুরস্কার হিসেবেই । এতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে গিয়েছিল । নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস ও সততা না থাকলে একথা বলা যায় না ।

    অন্যদিকে বুদ্ধদেব গুহর সাহিত্যের জগৎ বাংলা সাহিত্যে অভিনব । বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় আরণ্যক জীবনের যে পরিচয় দিয়েছেন,তার মধ্যে প্রকৃতি ও মানুষের কথা যেভাবে উঠে এসেছে,তাতে যৌনতা ও হিংসা নেই। বন আছে,অথচ বন্যতা নেই। সেখানে অরণ্যে পশু শিকার সুদূরপরাহত । সেদিক থেকে বাংলা সাহিত্যে অরণ্যের জগৎকেই বুদ্ধদেব নিবিড় তুলেছেন,শিকারকে দিয়েছেন বনেদি আভিজাত্য । তার সঙ্গে রোমাঞ্চকর প্রেমের পরশ ছড়িয়ে তার আবেদনকে জনপ্রিয় করে তুলেছেন। সেই বুদ্ধদেব গুহ আবার রবীন্দ্র সঙ্গীতজ্ঞ । খালি গলায় গানও করতেন । তাঁর স্ত্রী বিশিষ্ট রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী ঋতু গুহকে পাওয়ার জন্য কীভাবে লুকিয়ে থাকতেন,সে বিষয়েও তিনি অকপট স্পষ্টবাদী। সেসব মোটামুটি আগেই জেনেছিলাম । ক্লাসে পেয়ে ভাবলাম তাঁর লেখালেখি নিয়ে কিছু জেনে নেব । ধোপদুরস্ত ধুতিপাঞ্জাবিতে শোভিত সুপুরুষ বুদ্ধদেব আমাদের দুচোখের বিস্ময় কাটিয়ে স্বাভাবিক হলেন ঠিকই,আবার বিস্মিতও করলেন । আসলে লেখকের বই পড়ে যেমন ভাবা যায়, বাস্তবে তার মিলের অভাবই সুবিদিত। এ ভয় তখনও আমার ছিল। মিলেও গেল। যেভাবে তিনি লেখকের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আর পাঁচ জন মানুষ হয়ে উঠেছেন,তা ছিল একান্তই অভাবিত। নিজের শরীরের বলিষ্ঠ পরিচয়ে প্রেম উবে গেল,দেহ নিরাবরণ হল।

    জনৈক বিদেশিনীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের কথা অকপটে যেভাবে বললেন,তাতে সব গুলিয়ে যাচ্ছিল । লজ্জার কোনো চিহ্ন ছিল না মুখে, বরং মুখে তৃপ্তির প্রসন্নতা । মেয়েটির কেমন লেগেছিল,সেকথাও নাটকীয়ভাবে বললেন । ভালো বলে মেয়েটির তাঁকে তলপেটের চর্বি কমানোর পরামর্শ আজও কানে বাজে। আমাদের এক সহপাঠিনী তাঁকে তাঁর স্বামীর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি নিয়ে পরামর্শ চাইতেই তিনি স্বামীকে ভালবাসার পরামর্শ দেন। তাতে তাঁরও স্ত্রীর সঙ্গে অসুখী সম্পর্কের কথা মনে হয়েছিল । শেষে পেলাম এক সহপাঠীর প্রশ্নের উত্তরে দীর্ঘ দিনের কৌতূহল মেটানো সদুত্তর । তিনি কেন মৃত্যুর পরে বাঘ হতে চেয়েছেন,এই ছিল প্রশ্ন । বাঘ যে একা থাকে,এমনকি বাঘিনীও তার সঙ্গে থাকে না, এরূপ বনের রাজাই তিনি হতে চেয়েছিলেন । সেদিক থেকে তাঁর আশা পৃরণ হবে কিনা জানি না। তবে বাংলা সাহিত্যে তিনি বাঘের মতোই নিঃসঙ্গ অথচ বনের রাজার মতোই রাজত্ব করে গিয়েছেন । আসলে শিকারের মধ্যে যে রাজকীয়তা বর্তমান,তা বুদ্ধদেব গুহই বাংলা কথাসাহিত্যে নিবিড় করে তুলেছেন । তাঁর মতো দুঃসাহসী শিকারি লেখক বাংলার অরণ্য সাহিত্যে শুধু বিরল নয়,একমেবাদ্বিতীয়ম ।

  • Link to this news (দৈনিক স্টেটসম্যান)