প্রজাতান্ত্রিক দেশের ছেলে আমি। এখন থাকি রাজতন্ত্রে! কাঁচরাপাড়ার রেল কলোনির কোয়ার্টার্সের সেই সবুজে ভরা মাঠটা পিছনে ফেলে, কর্মজীবনের অনেকটা সময় দেশে কাজ করে বছর সাতেক আগে পা রেখেছিলাম কাতারে। সেটাও কাজেরই সূত্রে। তার পর পশ্চিম এশিয়ার এই ছোট্ট, সুন্দর দেশটাই আমার ঠিকানা। থাকি কাতারের রাজধানী দোহায়, এয়ারক্রাফট মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করি আল উদাইদ এয়ারবেসে।এখানে দারিদ্র নেই, খিদের জ্বালা নেই। একে অন্যের রুটি ছিনিয়ে নেওয়ার প্রবণতা নেই, তাই রুটির জন্য লড়াইও নেই। জীবনের অর্ধেকের বেশি সময় বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশে কাটিয়ে আসার পরেও তাই রাজতন্ত্রের সুশৃঙ্খলা দেখে মুগ্ধ হই রোজ। শুক্রবারটা শুধু এখনও পুরোনো অভ্যাসের মতো সাতসকালে উঠে পড়ি। খেয়াল থাকে না, ওটা জুম্মাবার, এদেশে ছুটি।
আবার ঘুমিয়ে পড়ি তখন। কিন্তু ঘণ্টাখানেক পরে ঠিক সেটা ভেঙে যায় স্বর্গীয় সুঘ্রাণে। বুঝতে পারি, প্রতিবেশী আজমের ভাই মোরগ পোলাও বানাচ্ছেন এই জুম্মায়। ছুটির দিনে পাতপেড়ে জমজমাট খাওয়া হবে ভেবেই বিছানা ছাড়ি। চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কখনও ভাবতে থাকি, ভাগ্যে কাতারও লেখা ছিল!
আটের দশকে আমার শৈশব, স্কুলজীবনের রুটিনটা জুড়ে বিকেলের ফুটবল, কখনও স্কাউট, আড্ডা। পাশে রেললাইন কাঁপিয়ে হর্ন বাজিয়ে ছুটে যেত ট্রেন। শর্ত ছিল একটাই। রাস্তার লাইট জ্বলার আগে বাড়ি ফিরতে হবে। হাতেখড়ি হয়েছিল রেলওয়ে মিক্সড প্রাইমারি স্কুলে। সেখান থেকে কাঁচরাপাড়া হার্নেট হাইস্কুল। পড়াশোনায় ভালো ছিলাম। ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ড — কিছু একটা বরাবরই হয়েছি ক্লাস টেন পর্যন্ত।
তখন শুনতাম ‘শিক্ষায় মাতৃভাষাই মাতৃদুগ্ধ’। ইংরেজি ছিল ক্লাস সিক্স থেকে। বাবা-কাকাদের রাজনৈতিক আলোচনায় বারবার শুনতাম ‘কেন্দ্রের বঞ্চনা’। স্কুলে পড়ার সময়ে দেশের দু’জন প্রধানমন্ত্রীকে খুন হতে দেখেছি। ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধী, ১৯৯১ রাজীব গান্ধী। সেই অস্থির সময়টা এখনও মনে পড়ে।
মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করেছিলাম। তারপর কিছুটা ছাত্র রাজনীতিতে অতি সক্রিয়তা, আর কিছুটা স্কুল পালিয়ে ভিডিয়ো পার্লারে সিনেমা দেখার আসক্তিতে উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট ভালো হলো না। ১৯৯১ সালে নৈহাটির ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র কলেজে ভর্তি হলাম ইকোনমিক্স অনার্স নিয়ে। সেকেন্ড ইয়ারে মনে হলো, স্বাবলম্বী হওয়া জরুরি।
ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সের টেকনিক্যাল রিক্রুটমেন্টের ফর্ম ভরে চিঠি পাঠিয়ে দিলাম ওদের দেওয়া ঠিকানায়। তারপর কল লেটার, পরীক্ষার ডাক। পার্ট ওয়ান পরীক্ষার পরে জয়েনিং লেটারও চলে এলো মেকানিক্যাল ট্রান্সপোর্ট ট্রেনিং ইনস্টিটিউট থেকে। দ্বিতীয় বার না ভেবে বাক্স-প্যাঁটরা গুছিয়ে জীবনে প্রথমবার হাওড়া থেকে মাদ্রাজ মেল ধরে রওনা দিলাম তামিলনাড়ুর আবাডিতে।
দেখতে গেলে, এয়ারফোর্স আমার জীবন থেকে অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে। আমার উচ্ছলতা, বন্ধুবান্ধব, আমার আড্ডার ঠেক, আমার যৌবনের কুড়িটা বছর। আবার যা দিয়েছে, তা অমূল্য। এয়ারফোর্সই শিখিয়েছে নিয়মানুবর্তিতা, ভ্রাতৃত্ববোধ, সৌজন্য, সহমর্মিতা এবং দেশপ্রেমের মানে। দেশের নানা প্রান্তে পোস্টিংয়ের সুবাদে কত বর্ণ, ধর্ম, ভাষার মানুষকে চেনার সুযোগ পেয়েছি।
১৯৯৯ সালে কার্গিল যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম। তার আগের বছরেই বিয়ে করি, পাত্রী কাঁচরাপাড়ারই। যুদ্ধ হয়তো খুব বেশি করে জীবনের প্রকৃত মূল্য শিখিয়ে দেয়। আমার ক্ষেত্রে অন্তত সেরকমই হয়েছে। ২০ বছরের বন্ড পূর্ণ হতে ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে বায়ুসেনা থেকে অবসর নিই। শেষ পোস্টিং ছিল গুজরাটের কচ্ছে। তার পর কলকাতার একটা বেসরকারি কোম্পানিতে জয়েন করলাম ওয়ার্কশপ ম্যানেজার হিসেবে। অনেক বছর পরে বাংলায় ফিরে ভেবেছিলাম, চেনা মাটিতে গাছ ভালোই শিকড় আঁকড়ে ধরবে।
কিন্তু আর্মি লাইফের শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনের সাথে কর্পোরেটের কালচার খাপ খেল না, অফিসের রাজনীতিও হজম হলো না। ছ’মাস পরেই ফিরে গেলাম দিল্লি। এবার ইন্ডিয়ান অয়েল স্কাই ট্যাঙ্কিংয়ে জয়েন করলাম অপারেশনস অফিসার হিসেবে। অফিস ছিল ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।
এই ২০১৪-১৬ ছিল জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়। নানা কারণে প্রথম বিয়েটা ভেঙে গিয়েছিল। সেই যন্ত্রণার সঙ্গে জুড়েছিল নতুন কর্মসংস্কৃতিতে খাপ খাইয়ে নিতে না পারার হীনমন্যতা। মনে হয়েছিল, আর বোধহয় মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব না। তখন হঠাৎই একদিন দেখা হয়ে গেল সরস্বতীর সঙ্গে। ক্লাস নাইনে হীরালালবাবুর ব্যাচে বাংলা-ইংরেজি পড়তে গিয়ে আলাপ।
খুব ভালো লাগত, বলে ওঠা হয়নি। ফের দেখাটা হলো বছর ৩০ পর। তখন দু’জনেই জীবনের অনেকগুলো কঠিন পর্ব পেরিয়ে এসেছি। বিয়ে করলাম দু’জনে। জীবন একটা নতুন পূর্ণতার দিকে এগোচ্ছিল। তখনই কাতারে আমিরি এয়ারফোর্সে এয়ারক্রাফট মেইনটেন্যান্স-এর অফার আসে। সেই থেকেই আমরা কাতারে।
কাতারে অনেক বঙ্গসন্তান আছেন। তবে পশ্চিমবঙ্গের থেকে বাংলাদেশি অনেকটাই বেশি। এখানে উইকএন্ডে আমরা ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডলি ক্রিকেট ম্যাচ খেলি। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের কোনও একটা দিন অডিটোরিয়াম ভাড়া করে রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যা করি। আর প্রত্যেক জুম্মার ছুটিতে অপেক্ষায় থাকি, কখন মঈনভাই অথবা দাউদভাই হাতে করে একটা বাটি নিয়ে এসে বলবেন, ‘দাদা, একটু হালিম রাঁধসি, চাইখ্যা দ্যাহেন। গত জুম্মায় আপনে মাছের মাথা দিয়া যে ডাইলডা বানাইসিলেন, হেইডাও একঘর হইসিলো!’
মা-বাবা গত হয়েছেন এখন। হালিশহরের বাড়িটা তালাবন্ধ পড়ে আছে। একমাত্র ছোট ভাই অনেক বছর ধরেই সপরিবার নরওয়েবাসী। আমি ছিন্নমূল বৃক্ষ, হয়তো আজীবন ছিন্নমূলই রয়ে যেতাম, যদি না সরস্বতীর সঙ্গে আবার দেখাটা না হতো।