অর্ণব আইচ: বউবাজারের হস্টেলের ভিতর গণধোলাইয়ে খুনের ঘটনায় ‘পালের গোদা’দের শনাক্ত করল পুলিশ। পুলিশের অভিযোগ, ওই হস্টেলের নাইটগার্ড শঙ্কর বর্মন ও রাঁধুনির সহকারী দূতকুমার মণ্ডল নিহত যুূবক ইরশাদ আলমকে রাস্তা থেকে ভিতরে টেনে নিয়ে এসে মারধর করার জন্য বাকি বারোজন আবাসিক ছাত্রকে নির্দেশ দেয়। মশারির দড়ি দিয়ে ইরশাদের হাত-পা বেঁধে তাঁকে মারধর করা হয়। নাইটগার্ড হিসাবে শঙ্কর বর্মনের কাছে হস্টেলের গেটের চাবি ছিল। পুলিশ আসার পরও প্রায় এক ঘণ্টা সে গেটের চাবি অন্য কোনও ছাত্রের হাতেও দেয়নি। তাই ভিতরে ঢুকতে পারেনি পুলিশ। ওই সময়টুকুর জন্যও ইরশাদকে ক্রমাগত মারা হয়। এমনকী, পুলিশ ইরশাদকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরই প্রমাণ লোপাটের জন্য শংকর, দূতকুমার ও আরও এক ছাত্র পাশে একটি নামী ফুড চেনের খাবারের দোকানে যায়। তারাই প্রায় দেড় ঘণ্টার ফুটেজ মুছে দেয়।
তাই ইরশাদকে ‘অপহরণ’ করে হস্টেলে নিয়ে যাওয়ার ফুটেজ মেলেনি। এই গণধোলাইয়ে খুনের ঘটনায় ধৃত ১৪ জনের বয়ানেও যথেষ্ট অসঙ্গতি রয়েছে। একে অনে্যর উপর দোষারোপ করলেও ছাত্রদের মুখে উঠে এসেছে শঙ্কর ও দূতকুমারের নাম। ঘটনার সময় হস্টেলের সুপার সেখানে ছিলেন না। যদিও তাঁকে মুচিপাড়া থানার পুলিশ তলব করেছে। সোমবার ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরাও ঘটনাস্থলে যেতে পারেন। ওই হস্টেলের ভিতর থেকে গণধোলাইয়ের জন্য ব্যবহার হওয়া দু’টি ব্যাট, পাঁচটি উইকেট ও লাঠি এবং দড়ি উদ্ধার হয়েছে। ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা সেগুলি পরীক্ষা করবেন। পুলিশের দাবি, প্রায় সাতজন ক্রমাগত ইরশাদকে মারে। বাকিরা মদত জোগায়।
পুলিশ জানিয়েছে, গত বৃহস্পতিবার হস্টেলের একতলার ঘর থেকে শঙ্কর বর্মনের মোবাইল চুরি যাওয়ার পর পাশে খাবারের দোকানের সিসিটিভির ফুটেজ তারা দেখে। সেখানে কালো রঙের ফুলহাতা গেঞ্জি পরে একজনকে হস্টেলে ঢুকতে দেখা যায়। প্রায় ১৫ মিনিট পর সে বেরিয়ে আসে। কিন্তু ওই ব্যক্তি অনেকটাই মোটা। সেই তুলনায় নিহত ইরশাদ চেহারায় রোগা। ফলে সে যে চুরির অভিযুক্ত নয়, সেই ব্যাপারে অনেকটাই নিশ্চিত পুলিশ। তবু শুক্রবার সকাল থেকে মোবাইল চোর ধরতে হস্টেলের সামনে ঘোরাঘুরি করতে থাকে ছাত্ররা। সকাল আটটা নাগাদ ইরশাদকে ঘোরাঘুরি করতে দেখেই তাদের সন্দেহ হয়।
পুলিশ জেনেছে, আশপাশের কয়েকজন দোকানদারও তাদের ইন্ধন জোগায়। এর পরই তারা টেনে হিঁচড়ে ইরশাদকে হস্টেলের ভিতর নিয়ে গিয়ে তালা বন্ধ করে দেয়। শংকর বর্মন এখন ওই হস্টেলে ‘নাইট গার্ড ও দারোয়ান’-এর চাকরি করলেও আসলে কোচবিহারের বাসিন্দা ওই যুবক ২০১৯ সালে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন নিয়ে পাস করে। দূতকুমার মণ্ডল ২০১৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংস্কৃতে এমএ পাস করে। এখন সে এই হস্টেলের রাঁধুুনির সহকারী হিসাবে কর্মরত। এই দু’জনই প্রাক্তন ছাত্র হওয়ার কারণে আবাসিক ছাত্রদের ‘সিনিয়র দাদা’।
ধৃতদের জেরা করে পুলিশ জেনেছে, মূলত শংকর, দূতকুমার ও আরও জনা দু’য়েকের নির্দেশেই হিঁচড়ে ভিতরে নিয়ে আসা হয় ইরশাদকে। তাঁকে দোতলায় নিয়ে গিয়ে মশারির দড়ি দিয়ে হাত-পা বেঁধে ফেলা হয়। টানা আড়াই ঘণ্টা ধরে তাঁকে ব্যাট, উইকেট দিয়ে মারা হয়। তিনি মোবাইল চুরির কথা অস্বীকার করলে তাঁর গলা টিপে ধরা হয়। তাঁর গলা, পায়ের দু’জায়গায়, দু’টি আঙুল ও বুকের হাড় ভেঙে যায়। টিভির মেকানিক ইরশাদ তাঁর দোকানের মালিককে ফোন করে ‘বউবাজারের হস্টেলে’ আটকে রেখে তাঁকে মারধরের কথা বলে জানান, ছাত্ররা দশ হাজার টাকা চাইছে। তিন বার ফোনে দু’জনের কথা হয়। প্রথমে মালিক বউবাজারে ইরশাদের খোঁজ পেতে নিজের লোক পাঠান।
কিন্তু তিনি বাড়ি খুঁজে পাননি। তাই মালিক নিজেই বউবাজার থানায় গিয়ে পুলিশ আধিকারিকদের নিয়ে হস্টেলে যান। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই মুচিপাড়া থানার এক আধিকারিকও খবর পেয়ে হস্টেলে পৌঁছন। দুই থানার পুলিশ আধিকারিকরা ছাত্রদের গেট খুলতে বলেন। কিন্তু পুলিশকে দেখে কয়েকজন ছাত্র নিজেদের মধ্যে হাসাহাসিও করে। দোতলায় গিয়ে তারা শঙ্কর বর্মনকে চাবি দিতে বললেও সে রাজি হননি। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে পুলিশ ক্রমাগত বলার পর ছাত্ররা গেট খোলে। পুলিশ দোতলায় গিয়ে দেখে, মারের চোটে প্রায় অচেতন হয়ে পড়ে রয়েছেন ইরশাদ। এই ব্যাপারে আরও তথ্য জানতে ধৃতদের জেরা চলছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।