• চিকিৎসক দিবসে বর্ধমানের 'ঈশ্বর'-এর খোঁজ নিল আজকাল ডট ইন...
    আজকাল | ০১ জুলাই ২০২৪
  • বিভাস ভট্টাচার্য: 'হাঁ মা, হাঁ। মৃত্যুভয়! মৃত্যুভয়! পড়ে মরব! সিমিলিয়া সিমলিবস, কিউরেন্টার! মহাত্মা হেরিং বলেচেন, রোগের নয়, রোগীর চিকিৎসা করবে। মৃত্যুভয়ে একোনাইট প্রধান।'

    'কী দেখছো? আরে বাবা কিছু হয়নি। ওষুধগুলো ঠিকঠাক খেয়ো আর সঙ্গে যা যা বললাম সেগুলো করো। ভয় নেই, রোগ আর পেছনে তাড়া করবে না।'

    প্রথমজন অবশ্যই শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'বামুনের মেয়ে' উপন্যাসের হোমিওপ্যাথি ডাক্তার প্রিয় মুখুজ্যে। কিন্তু দ্বিতীয়জন? বর্ধমান ও তার আশপাশের জেলার গরীবের চিকিৎসক বলে পরিচিত ডাক্তার নিতাই প্রামাণিক। যাঁর চিকিৎসার গুণে আর মধুর ব্যবহারে রোগী নিশ্চিন্ত, 'নিতাই ডাক্তারের কাছে যখন এসেছি, আর ভয় নেই।'

    স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে নিতাই প্রামাণিকের কথা বলতে প্রিয় মুখুজ্যের উদাহরণ টানা কেন? কারণ, গল্পের প্রিয় মুখুজ্যে যেমন রোগী অন্ত প্রাণ, বাস্তবের নিতাই প্রামাণিকও রোগীর বাইরে কিছু জানেন না। নাওয়া খাওয়া ভুলে তিনি রোগ নিরাময়ের ওষুধ খুঁজে বেড়ান।

    বর্ধমানের বিবেকানন্দ কলেজ মোড়ে বাড়ি। চিকিৎসক হিসেবে রাজ্যের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল ছাড়াও ১৭ বছর কলকাতায় স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিন-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অথচ ট্রপিক্যাল মেডিসিন নিয়ে স্নাতকোত্তর ডা. নিতাই প্রামাণিক ভালো চিকিৎসক হিসেবে কলকাতায় পরিচিত হওয়া সত্ত্বেও কোনোদিনই যুক্ত হননি কোনও বেসরকারি হাসপাতাল বা নার্সিং হোমের সঙ্গে। কাজ শেষে ফিরে গিয়েছেন গ্রামে। একেবারেই সাধারণ মানুষের চিকিৎসার প্রয়োজনে। সেজন্যই তাঁর পরিচিতি 'গরীবের ভগবান' বলে।

    না, নিতাই প্রামাণিকের কিন্তু এসব নিয়ে কোনও হেলদোল নেই। সেজন্যই বৈদ্যুতিন সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধি যখন সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য তাঁর দিকে 'বুম' বাড়িয়ে দেন, তখন তিনি বলে ওঠেন 'না, না, ওসব প্রচার-টোচার দিয়ে কিছু হয় না।'

    ডা. বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় বা সাহিত্যিক বনফুল সম্পর্কে একটা গল্প আছে। তিনি একদিন ট্রেন ধরতে স্টেশনে দেরি করে এসেছিলেন। গাড়ি তখন ছেড়ে দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। হতাশ বনফুল যখন বুঝে উঠতে পারছিলেন না কী করবেন তখন দেখেন ছেড়ে যাওয়া ট্রেন আবার স্টেশনেই ফিরে আসছে। ট্রেনের গার্ড বনফুলকে দেখতে পেয়ে নাকি ট্রেন আবার ফিরিয়ে এনেছিলেন। ডা.নিতাই প্রামাণিকের জন্য ট্রেন কোনওদিন ফিরে না এলেও এলাকার লোকের দাবি, তিনি যে ট্রেনে করে কলকাতা যেতেন, সেই ট্রেন দু'একদিন সিগন্যাল থাকা সত্ত্বেও দেরি করে ছেড়েছিল। তাঁর দেরিতে স্টেশনে পৌঁছনোর জন্য। ট্রেনের মধ্যেই তিনি রোগীদের পরামর্শ দিতে দিতে যেতেন। ডাক্তারবাবুর বসার জায়গার ব্যবস্থা করতেন সহযাত্রীরাই।

    কলকাতা থেকে ফিরে রাত ন'টা থেকে তিনি বাড়িতে রোগী দেখা শুরু করতেন। রোগীর ভিড়ে কখনও পেরিয়ে যেত মাঝরাত। অবসরের পর এখন তাঁর রোগী দেখা শুরু হয় ভোড় পাঁচটা থেকে। কারণ হিসেবে বলেন, 'ওঁরা অতদূর থেকে কাজ ফেলে আসেন। তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিলে আবার ফিরে গিয়ে কাজ করতে পারবেন।' কত টাকা ভিজিট নেন তিনি? নামী চিকিৎসক হিসেবে খ্যাতি থাকলেও জীবনে ৫০ টাকার বেশি ভিজিট তিনি পাননি। পাওয়ার কথাও নয়। কারণ, তাঁর অধিকাংশ রোগীই গ্রামের চাষি, ক্ষেতমজুর বা একেবারেই দিন আনা দিন খাওয়া লোক। প্রয়োজনে যাঁদের তিনি ওষুধও কিনে দেন। রোগ সেরে যাওয়ার পর কেউ কেউ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে নিয়ে যান বাড়িতে বা ক্ষেতে হওয়া একটা লাউ বা কুমড়ো। অবস্থাপন্ন লোকেরা কি তাঁর কাছে যান না? হ্যাঁ, তাঁরাও যান। কিন্তু মুখ ফুটে কোনওদিন তাঁদের কাছে তিনি ভিজিট চান না।‌ কারণ, চিকিৎসক হিসেবে তাঁর মূলমন্ত্র হল সেবা। সেজন্যই যুক্ত আছেন ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের সঙ্গেও। যান বিভিন্ন মেডিক্যাল ক্যাম্পে।

    গাড়ি, বাড়ি বা দামী ফার্নিচার ডা. নিতাই প্রামাণিকের বাড়িতে নেই। সেজন্য স্ত্রী বা দুই মেয়ের থেকে কোনোদিন গঞ্জনা তাঁকে শুনতে হয়নি। তাঁর বড় মেয়ে ডাক্তারি পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ছোট মেয়ে কলেজ ছাত্রী।

    বর্তমান একই 'ল্যাবরেটরি' নির্ভর চিকিৎসার যুগে দাঁড়িয়েও তিনি রোগীদের এটা সেটা প্রচুর পরীক্ষার জন্য বলেন না। একেবারে কচি বাচ্চা থেকে বৃদ্ধ, সকলের চিকিৎসাই করেন। নিজেই বলেন, 'ইন্টার্নশিপ করার সময় একজন ডাক্তারকে সব বিভাগই ঘুরে ঘুরে দেখতে হয়। তাই যেকোনও রোগের কিছুটা অন্তত বোঝেন সব ডাক্তার'।অবশ্যই রোগীর হাসপাতালে রেফার বা অস্ত্রোপচারের প্রয়োজনে কেস হিস্ট্রি লিখে পাঠিয়ে দেন।

    'অগ্নিশ্বর' সিনেমায় মোগলসরাইয়ের স্টোরবাবু হরিধন মুখোপাধ্যায় ডা.অগ্নিশ্বর রূপী উত্তমকুমারের মানবিক রূপ দেখে বলে উঠেছিলেন 'দেবতা'। বর্ধমান ও তার আশপাশের জেলার গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষের কাছেও ডা. নিতাই প্রামাণিক 'ঈশ্বর'।
  • Link to this news (আজকাল)