• পুর নিয়মই সার, গার্ডেনরিচের পরেও বহাল তবিয়তে বেআইনি নির্মাণ
    আনন্দবাজার | ০১ জুলাই ২০২৪
  • রাস্তার ধারে চারতলা বাড়ির নীচে গোটা চারেক দোকান। পুরসভার অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী ওই বাড়ির তেতলা পর্যন্ত ছাড় রয়েছে। বাস্তবে অবশ্য সে সবের তোয়াক্কা করা হয়নি। বিনা অনুমোদনে দ্বিতীয় তলের উপরে উঠে গিয়েছে আরও একটি তলা। অভিযোগ, বহুতল তৈরিতে পুরসভার নিয়মকে ‘বুড়ো আঙুল’ দেখানো হয়েছে প্রতি পদক্ষেপে।

    মাস চারেক আগে চিৎপুর থানা এলাকার উমাকান্ত সেন লেনে বেআইনি নির্মাণের এ হেন অভিযোগ পেয়ে সেখানে অভিযানে গিয়েছিলেন পুলিশ এবং পুরকর্মীরা। প্রথমে কয়েক বার বিক্ষোভ এবং স্থানীয় ‘দাদা’র প্রভাবে বহুতলের বেআইনি অংশ না ভেঙেই ফিরে আসতে হয়েছিল পুলিশকে। পরে আরও কয়েক বার অভিযানের পরে বাড়িটির অবৈধ অংশ ভাঙতে সক্ষম হন পুরকর্মীরা। বন্ধ করে দেওয়া হয় কাজ। কিন্তু মাসখানেক যেতে না যেতেই ফের শুরু হয় নির্মাণ। ভাঙা অংশটুকু মেরামত করে আবারও বহুতলটি বাসযোগ্য করে নেওয়া হয়। অভিযোগ, এ বার স্থানীয় বাসিন্দারা পুলিশ ও পুরসভাকে জানালেও ফের কাজ বন্ধ করা তো দূর, কোনও এক অজ্ঞাত কারণে কেউ সে দিকে ফিরেও তাকাননি।

    শহরে বেআইনি নির্মাণের রমরমা নিয়ে সম্প্রতি নবান্নে এক বৈঠকে একাধিক পুরসভাকে তুলোধোনা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাদ যায়নি কলকাতা পুরসভাও। মুখ্যমন্ত্রীর মুখে উঠে এসেছে প্রোমোটার-ঠিকাদার যোগসাজশের কথাও। বেআইনি নির্মাণের পিছনে কার বা কাদের মদত থাকছে, তা নিয়ে উষ্মা প্রকাশের পাশাপাশি এমন নির্মাণের ফলে ভবিষ্যতে বড় অঘটন ঘটলে সেই দায় কে নেবে, সে প্রশ্নও তুলেছেন মমতা। এই পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর ইঙ্গিত ছিল গার্ডেনরিচের ঘটনার দিকে। মাস তিনেক আগে সেখানে একটি নির্মীয়মাণ বেআইনি বহুতল ভেঙে মারা যান ১৩ জন। তার পরে বেআইনি নির্মাণের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নেওয়ার কথা জানিয়েছিল কলকাতা পুরসভা। পুর ইঞ্জিনিয়ারদের এলাকা ঘুরে দেখার নির্দেশও দেওয়া হয়।

    কিন্তু তার পরে কি আদৌ বন্ধ হয়েছে বেআইনি নির্মাণ? শহরের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে এই প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর অন্তত মিলছে না। বরং, ভয়াবহ ছবি নজরে আসছে। কোথাও নিচু জমিতে আবর্জনা ফেলে ভরাট করে বহুতল তুলে ফেলা হয়েছে, কোথাও বহুতল তৈরি হচ্ছে কোনও নিয়ম বা অনুমতির পরোয়া না করেই। আনন্দপুরের পশ্চিম চৌবাগা, গুলশন কলোনি, কড়েয়া, তিলজলা বা ইএম বাইপাসের ধারে নয়াবাদ— প্রকাশ্যে প্রায় সর্বত্র বহাল তবিয়তে চলছে বেআইনি নির্মাণ। সাদা চোখে এই নির্মাণ সাধারণ মানুষের নজরে এলেও কোনও অজ্ঞাত কারণে তা পুলিশ বা পুরপ্রতিনিধিদের নজরে আসছে না বলেও অভিযোগ। নয়াবাদ এলাকায় এমনই একটি বেআইনি নির্মাণ নিয়ে প্রশ্ন করায় স্থানীয় এক বাসিন্দা বললেন, ‘‘নজরদারি চালিয়ে অভিযোগ জানাবে কে? কাগজেকলমে কোনও নিয়মে এখানে কাজ হয় না। পাড়ার ‘দাদা’-‘দিদি’রা যা বলবেন, যা ভাববেন, সেটাই নিয়ম। ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল’-এর অবস্থা।’’

    জানা গিয়েছে, একবালপুর, গার্ডেনরিচ, কড়েয়া, রাজাবাগান, তিলজলা এলাকায় বেআইনি নির্মাণ নিয়ে পুলিশের কাছে ভূরি ভূরি অভিযোগ এসেছে। কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়ার সংখ্যা হাতে গোনা। পুলিশের দাবি, তদন্তের পাশাপাশি বেআইনি নির্মাণ সংক্রান্ত অভিযোগ এলে পুরসভা এবং সংশ্লিষ্ট পুরপ্রতিনিধিকে জানানো হয়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরবর্তী কালে পুরপ্রতিনিধি বা পুরসভার তরফে পুলিশকে কিছু জানানো হয় না। যার ফল, বেআইনি নির্মাণের অভিযোগ এলেও তাদের কার্যত হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হয় বলেই দাবি করছে পুলিশের একাংশ।

    পুরসভার যদিও দাবি, বেআইনি নির্মাণের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়া হয়েছে। সাধারণ মানুষও যাতে বেআইনি নির্মাণের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে পারেন, সে কারণে অনুমোদিত নকশা পুরসভার ওয়েবসাইটে নিয়মিত আপলোড করা হচ্ছে। এ ছাড়া, তৎপরতা বেড়েছে বেআইনি নির্মাণ ভাঙার ক্ষেত্রেও। পুর বিল্ডিং দফতর সূত্রের খবর, আগে যেখানে প্রতিদিন গড়ে ৫-৬টি করে অবৈধ নির্মাণ ভাঙা হত, মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষোভের পরে গত বুধবার সেখানে ১২টি বাড়ি ভাঙার নির্দেশ ছিল। তার মধ্যে পুরসভা ভেঙেছে ৯টি। বৃহস্পতি ও শুক্রবার কলকাতায় যথাক্রমে ১০টি করে বেআইনি বাড়ি ভাঙার অনুমোদন মিলেছে। বিল্ডিং বিভাগের এক কর্তার কথায়, ‘‘অভিযোগ এলে খতিয়ে দেখে তবেই ব্যবস্থা নিতে হয়। সেই ভাবেই করা হচ্ছে।’’

    কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়ার পরে সেখানেই ফের বেআইনি নির্মাণ শুরু হলে সে ক্ষেত্রে নজর রাখবে কে? এই প্রশ্নের উত্তর অবশ্য মেলেনি।

    (চলবে)

  • Link to this news (আনন্দবাজার)