• শীর্ষ কোর্টে 'নিগৃহীতা', প্রশ্ন রক্ষাকবচে
    এই সময় | ০৪ জুলাই ২০২৪
  • এই সময়: মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্যে তাঁর সম্মানহানি হয়েছে বলে অভিযোগ তুলে নজিরবিহীন ভাবে কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। বুধবার হাইকোর্টে সেই মামলার শুনানি শুরু হলো। তবে যাঁর বিরুদ্ধে মানহানি করার অভিযোগ, সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছেই এ দিন দুপুর পর্যন্ত মামলার নথি পৌঁছে দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ তুললেন মুখ্যমন্ত্রীর আইনজীবী।বুধবার শুনানি শুরু হলেও বিচারপতি কৃষ্ণা রাও জানিয়ে দেন, যেহেতু রাজ্যপাল তাঁর মানহানি সংক্রান্ত মুখ্যমন্ত্রীর কোনও বক্তব্য নিজের কানে শোনেননি, সবটাই সংবাদমাধ্যম থেকে জেনেছেন, তাই সংশ্লিষ্ট সংবাদমাধ্যমকে মামলায় যুক্ত করতে হবে। আজ, বৃহস্পতিবার মামলার পরবর্তী শুনানি।

    রাজ্যপাল বোসের বিরুদ্ধে কিছুদিন আগে 'শ্লীলতাহানি'র অভিযোগ তুলেছিলেন যে তরুণী, তাঁর তরফে আবার সুপ্রিম কোর্টে একটি রিট পিটিশন করা হয়েছে এদিনই। সেখানে যেমন একদিকে অভিযোগকারিণী ও তাঁর পরিবারের নিরাপত্তা এবং তাঁর সম্মানহানির জন্যে ক্ষতিপূরণের আর্জি জানানো হয়েছে, তেমনই রাজ্য পুলিশ যাতে এই মামলায় তদন্ত চালাতে পারে সেই আবেদনও করা হয়েছে।

    ঘটনাচক্রে এদিনই দিল্লিতে বঙ্গভবনে অ্যাটর্নি জেনারেল আর ভেঙ্কটরামানির সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেছেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। এই বৈঠকের বিষয়ে অবশ্য বিস্তারিত জানানো হয়নি রাজভবনের তরফে। সদ্যসমাপ্ত বিধানসভা উপনির্বাচনে জয়ী দুই তৃণমূল বিধায়ক সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায় ও রেয়াত হোসেন সরকারের শপথগ্রহণ পর্ব নিয়ে গত বেশ কিছুদিন ধরেই টানাপড়েন চলছে। রাজ্যপাল বোস তাঁদের রাজভবনে শপথ নেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানালেও তাঁরা জানিয়ে দিয়েছেন, হয় রাজ্যপাল বিধানসভায় এসে তাঁদের শপথগ্রহণ করান অথবা বিধানসভার স্পিকার বা অন্য কাউকে এই দায়িত্ব দিন।

    এ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক'দিন আগে কিছু মন্তব্য করেছিলেন। সরাসরি কোনও প্রসঙ্গ উল্লেখ না-করলেও 'রাজভবনে যা সব কীর্তি-কেলেঙ্কারি চলছে, তাতে মেয়েরা ওখানে যেতে ভয় পাচ্ছে' বলে মমতা জানিয়েছিলেন সাংবাদিকদের সামনে। এরপরই কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন রাজ্যপাল।

    এর প্রেক্ষিতে এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর আইনজীবী সঞ্জয় বসু এক বিবৃতিতে বলেছেন, 'রাজভবনে মহিলারা নিজেদের নিরাপদ বোধ করছেন না বলে মুখ্যমন্ত্রী কিছু মন্তব্য করেছেন-এই অভিযোগে মুখ্যমন্ত্রী ও আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা দায়ের হয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি।' তাঁর যুক্তি, 'সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় যেখানে রাজভবন সংক্রান্ত কিছু অভিযোগ নিয়ে মহিলারা আইনরক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হয়েছেন, সেখানে মহিলাদের এই যন্ত্রণার কথা তুলে ধরা যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত। বিশেষ করে যখন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নিজেই একজন মহিলা।'

    সঞ্জয়ের দাবি, তাঁরা এদিন দুপুর পর্যন্ত মামলার প্রতিলিপি হাতে পাননি। তবে যেভাবে এই মামলা করা হয়েছে, তা 'রাজ্যপালের অন্যান্য রাজনৈতিক ইস্যু ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা' বলেও তাঁর দাবি। এই রাজনৈতিক ইস্যুর উদাহরণ হিসাবে সঞ্জয় উল্লেখ করেছেন, 'বিধানসভার নবনির্বাচিত সদস্যদের স্পিকারের কাছ থেকে শপথগ্রহণের অনুমতি দেওয়ার আবেদন রাজ্যপাল যে গ্রাহ্য করেননি, সেটাকে আড়াল করতেই এই মানহানির মামলা করা হয়েছে। আমরা যথাযথ ভাবে এর জবাব দেবো।'

    এদিন রাজ্যপালের হয়ে আইনজীবী তথা কেন্দ্রের সহকারী সলিসিটর জেনারেল ধীরজ ত্রিবেদী আদালতে বলেন, 'সংবাদমাধ্যম যা লেখা হয়েছে, সেটা উনি (মুখ্যমন্ত্রী) নিজেই বলেছেন। তাঁর ওই বক্তব্যের ভিডিয়ো রেকর্ডিংও আছে। গোটা বাংলা জানে, রাজ্যপালের বিরুদ্ধে কী কী বলা হয়েছে। তাতে রাজ্যপালের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে।'

    এরপরই বিচারপতি কৃষ্ণা রাও প্রশ্ন করেন,'মামলায় সংবাদমাধ্যমকে পার্টি করা হয়েছে?' রাজ্যপালের কৌঁসুলি সংশয়ের সুরে বলেন, 'এখানে কি সেটা প্রয়োজনীয়?' কিন্তু আদালত জানিয়ে দেয়, যে সব সংবাদমাধ্যমে বিয়টি প্রকাশিত হয়েছে, তাদের মামলায় যুক্ত করতে হবে।

    তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে এদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হয়ে হাইকোর্টে সওয়াল করার জন্য উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের দুই প্রাক্তন অ্যাডভোকেট জেনারেল তথা বর্ষীয়ান দুই আইনজীবী জয়ন্ত মিত্র ও সৌমেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। আদালতে সৌমেন্দ্রনাথ জানান, তিনি মুখ্যমন্ত্রীর হয়ে সওয়াল করবেন। জয়ন্ত মিত্র আলাদা করে কিছু উল্লেখ না করলেও পরবর্তী শুনানিতে তিনিও মুখ্যমন্ত্রীর হয়ে সওয়াল করবেন বলে সূত্রের খবর। রাজ্যের বর্তমান অ্যাডভোকেট জেনারেল কিশোর দত্তও এ দিনের শুনানিতে হাজির ছিলেন। তিনি রাজ্য সরকারের হয়ে সওয়াল করবেন।

    আদালতে রাজ্যপালের কৌঁসুলি ত্রিবেদী বলেন, মুখ্যমন্ত্রী ছাড়াও কুণাল ঘোষ, সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, রেয়াত হোসেনকেও মামলায় যুক্ত করা হয়েছে। এঁরা কেউ যাতে আগামী দিনে রাজ্যপালের বিরুদ্ধে কোনও মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন, তেমন নির্দেশ দেওয়ার জন্য ত্রিবেদী আর্জি জানান আদালতের কাছে। যদিও তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ এ দিন বলেন, 'আদালতে আমাদের আইনজীবীরা জবাব দেবেন। উনি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শপথ না করিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেছেন। রাজ্যপাল অকারণে পরিস্থিতিকে জটিল করছেন। কার বুদ্ধিতে মানহানির মামলা করেছেন তিনিই জানেন। মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যপাল পদের কোনও অসম্মান করেননি। রাজভবন নিয়ে পুলিশের কাছে কিছু অভিযোগ এসেছিল। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে মুখ্যমন্ত্রীর পর্যবেক্ষণ দেখতে পাওয়া গিয়েছে।'

    ইতিমধ্যে রাজ্যপালের বিরুদ্ধে 'শ্লীলতাহানি'র অভিযোগকারিণী সুপ্রিম কোর্টে যে আবেদন করেছেন, সেখানে বলা হয়েছে-সংবিধানের ৩৬১ নম্বর অনুচ্ছেদে রাজ্যপালের যে রক্ষাকবচ দেওয়া হয়েছে, তা চূড়ান্ত বলে ধরে নেওয়া যায় না। ওই রক্ষাকবচের অর্থ এটা হতে পারে না যে, তিনি বেআইনি কোনও কাজ করলে অথবা কোনও নাগরিকের মৌলিক অধিকার খর্ব করলেও তাঁর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা যাবে না।

    এই রক্ষাকবচের বলে কোনও অপরাধের তদন্তে রাজ্যপালের বয়ান রেকর্ড করা যাবে না-সেটাও হয় না। আবেদনে আরও যুক্তি দেওয়া হয়েছে-রক্ষাকবচের অর্থ যদি এটাই হয় যে, রাজ্যপাল পদ না-ছাড়া পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে কোনও তদন্তই করা যাবে না, তাহলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে তথ্যপ্রমাণ নষ্ট, সাক্ষীদের উপর প্রভাব খাটানো, প্রত্যক্ষদর্শীদের প্রভাবিত করার প্রবল সম্ভাবনাও থেকে যায়। এই পরিস্থিতিতে যাতে রাজ্যপালের বিরুদ্ধে তদন্ত এবং অভিযোগকারিণীকে নিরাপত্তা ও ক্ষতিপূরণের আবেদন সুপ্রিম কোর্ট মঞ্জুর করে, সে আর্জিও জানানো হয়েছে শীর্ষ আদালতে।
  • Link to this news (এই সময়)